মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১২ নভেম্বর: রাত পোহালেই মেদিনীপুর বিধানসভা উপনির্বাচন। ‘ঐতিহাসিক’ মেদিনীপুরে এবার লড়াই মূলত চতুর্মুখী। শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস আর প্রধান বিরোধী বিজেপি ছাড়াও লড়াইয়ের ময়দানে আছে বাম আর কংগ্রেসও। কোনও এক মহলের ‘উস্কানিতে’ প্রতিযোগিতায় নামার জন্য নাম লেখালেও (পড়ুন, মনোনয়ন জমা দিলেও); মাঠে নামার ‘সৎ-সাহস’ দেখাতে পারেন নি একমাত্র ‘নির্দল’ প্রার্থী নান্টু কুইল্যা! নান্টু পেয়েছেন ‘ব্যাট’ প্রতীক। তবে, পুরো প্রচার পর্ব জুড়ে মাঠের বাইরেই থাকলেন নারায়ণগড়ের বাসিন্দা তথা এলাকায় সক্রিয় বিজেপি কর্মী হিসেবে পরিচিত নান্টু। স্বাভাবিকভাবেই মেদিনীপুর বিধানসভার বাকি চার প্রার্থীর ‘লড়াই’ যে গ্যালারিতে বসেই উপভোগ করবেন নান্টু; তা বলাই বাহুল্য! সোমবার শেষ প্রচারের দিনও নান্টু জানিয়েছেন, “আমি এখন কোন মন্তব্য করব না।” কবে ‘মন্তব্য’ করবেন, তা না জানিয়েই কেটে দিয়েছেন ফোন!
এদিকে, শুরু থেকে শেষ, গোটা প্রচারপর্বের আলোয় থাকলেন যাঁরা; সেই তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সুজয় হাজরা, বিজেপি প্রার্থী শুভজিৎ রায়, কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামল ঘোষ আর বাম (সিপিআই) প্রার্থী মণিকুন্তল খামরুইয়ে ভাগ্য নির্ধারণ করতে প্রস্তুত মেদিনীপুর বিধানসভার ২ লক্ষ ৯১ হাজার ৬৪৩ জন ভোটার। ইতিমধ্যেই, মেদিনীপুর বিধানসভার ২৩৬ জন ৮৫ ঊর্ধ্ব এবং বিশেষভাবে সক্ষম ভোটার হোম ভোটিংয়ের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। এছাড়াও, পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমেও অনেকেই ইতিমধ্যে ভোট দিয়েছেন। অপরদিকে, মঙ্গলবার সকাল ১০টা-১১টা থেকেই মেদিনীপুর বিধানসভা উপনির্বাচনের একমাত্র ডিসি-আরসি সেন্টার মেদিনীপুর কলেজ থেকে প্রয়োজনীয় ভোট-সামগ্রী নিয়ে ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া শুরু করে ভোট কর্মীরা। উল্লেখ্য যে, মেদিনীপুর বিধানসভা উপনির্বাচনে প্রায় ২ লক্ষ ৯২ হাজার ভোটারের ভোটগ্রহণের জন্য জন্য প্রায় ১৮০০ ভোট কর্মী নিয়োগ করেছে নির্বাচন কমিশন। আছেন মহিলা ভোট কর্মীরাও। তাঁদের জন্য বরাদ্দ গাড়িতে করে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন ভোটকর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে এও উল্লেখ্য যে, সোমবার (১১ নভেম্বর) ছিল শেষ প্রচার। যথারীতি চার প্রার্থীর প্রচারেই ঝড় উঠেছিল। তৃণমূল প্রার্থী সুজয় হাজরার প্রচারে ঝড় তুলতে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজ্য যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী তথা যাদবপুরের ‘সেলিব্রেটি’ সাংসদ সায়নী ঘোষ। মেদিনীপুর শহরের ঐতিহাসিক কলেজ কলেজিয়েট মাঠ থেকে সুজয়ের সমর্থনে মহামিছিলে নেতৃত্ব দেন সায়নী। বর্ণাঢ্য এই মহামিছিল মেদিনীপুর শহরের রিং রোড পরিক্রমা করে। ছিলেন রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়ন ও সেচ দপ্তরের মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভুঁইয়া, প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মেদিনীপুর বিধানসভা উপনির্বাচনের জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলা তৃণমূল ও নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক দীনেন রায় প্রমুখ। মিছিল শুরুর আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রাজ্য যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী সায়নী ঘোষ বলেন, “মাঠ পুরো ফাঁকা। আমরা জিতে গেছি। জনতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে গোল দেবেন। আমাদের প্রার্থী সুজয় হাজরাকে ৩নং বোতাম টিপে বিপুল ভোটে জয়ী করবেন!” বিজেপির সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলায় বিজেপি বলে কিছু নেই। হিন্দু মুসলিম জৈন খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ বলেও জানিয়েছেন তিনি। সুজয় বলেন, “মেদিনীপুরের শান্তি, সৌহার্দ্য, সংস্কৃতি আর সম্প্রীতি বজায় রাখতে গেলে দিদির পাশে থাকুন। বাংলার প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইয়ের পাশে থাকুন। বুধবার সকাল সকাল নিজের ভোট নিজে দিন।”
অপরদিকে, সোমবার শেষ ভোট প্রচারে ঝড় তুলতে সাত সকালেই মেদিনীপুর শহরে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজেপি-র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা মেদিনীপুরের প্রাক্তন সাংসদ দিলীপ ঘোষও। রবিবার মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাঁদড়ার জনসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেও এক মঞ্চে ছিলেন দিলীপ। সোমবার হুডখোলা গাড়িতে মেদিনীপুর বিধানসভা উপনির্বাচনের BJP প্রার্থী শুভজিৎ রায়কে সঙ্গে নিয়ে সিপাইবাজারের জেলা কার্যালয় থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন তিনি। ছিলেন কাঁথির সাংসদ তথা মেদিনীপুর বিধানসভা উপনির্বাচনের ইনচার্জ সৌমেন্দু অধিকারী সহ জেলা বিজেপি-র অন্যান্য নেতৃত্বরাও। দিলীপ বলেন, “এখন থেকেই হুমকি দেওয়া শুরু হয়ে গেছে পুলিশ আর তৃণমূলের। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারলে বিজেপির প্রার্থীই জয়ী হবে।” আর, শুভজিৎ বলেন, “মানুষ আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে; বাংলায় দুর্নীতি আর নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভোট দিতে প্রস্তুত।” মঙ্গলবার সকালে তৃণমূলের তরফে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন শুভজিৎ। সেই সঙ্গে শহরে বহিরাগতদের নিয়ে আসা হচ্ছে বলে বিজেপি ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনের পারস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি ডঃ শঙ্কর গুছাইত। অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা প্রার্থী সুজয় হাজরা-র দাবি, “হতাশা থেকেই বিজেপি এই সমস্ত কথা বলছে।”
অন্যদিকে, এবারের ভোট প্রচারে বাম প্রার্থীর থেকেও বেশি নজর কেড়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামল কুমার ঘোষ। শহর থেকে গ্রামের মাঠে-ঘাটে দাপিয়ে প্রচার করেছেন তিনি। মিশে গিয়েছেন মানুষের সঙ্গে। দীর্ঘদিন পর ‘হাত’ চীনে মানুষ ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন বলে দাবি শ্যামলের। কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে বেকারদের জন্য তিনি লড়াই করবেন বলে জানিয়েছেন। ‘ভাতা’র রাজনীতি বন্ধ করে মেদিনীপুরে শিল্প আনার পক্ষে জোরালো সমান করেছেন কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামল ঘোষ। শালবনীর ডাঙরপাড়াতে নিজের গ্রামে ধান ঝাড়াই-মাড়াই থেকে শুরু করে মেদিনীপুর গ্রামীণে ট্রাক থেকে ইঁট নামানো- কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামলের বার্তা “আমি তোমাদেরই লোক!” মানুষ ভোট দিতে পারলে তিনি কমপক্ষে ১৫ হাজার ৫০০ ভোটে জিতবেন বলেও দাবি করেছেন কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামল কুমার ঘোষ। বাম প্রার্থী মণিকুন্তল খামরুইয়ের প্রচারে রবিবার মেদিনীপুর শহরে এসেছিলেন সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিম। মহামিছিল করেছেন শহরে। তার আগে বৃহস্পতিবার এসেছিলেন সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী। তাঁদের দাবি, বামেরা এবার ভাল ফল করবে। আর জি কর কাণ্ড সহ নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-রেশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ ভোট দেবেন বলে বাম প্রার্থী মণিকুন্তল খামরুইয়ের ‘আশা’!