দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ড. শুভেন্দু ঘোষ, ২ জুন: খুব স্বল্পকালের (সামান্য সময়ের জন্য) একটি প্রাকৃতিক বৈদ্যুতিক প্রবাহকে আমরা সাধারণভাবে বলে থাকি আকাশে বিদ্যুৎ এর চমক। যা বজ্রগর্ভ মেঘে ভয়ংকর বিপর্যয় সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে এটি হলো, মেঘ এবং ভূ-পৃষ্ঠের মধ্যে বা উচ্চ ও নিম্ন মেঘের মধ্যে উচ্চ ভোল্টেজসহ উজ্জ্বল আলোর ঝলক; যা আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত মনোরম একটি প্রাকৃতিক ঘটনা মনে হলেও বিদ্যুতের এই অসাধারণ ঝলক বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে এই বজ্রপাতের প্রদুর্ভাব সাম্প্রতিককালে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পশ্চিমের দেশগুলোতে সরকারি ও সামাজিক স্তরে এই সম্পর্কে সচেতনতা থাকলেও ভারত, বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার জনবহুল ও কৃষি নির্ভর দেশগুলিতে এই অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাটি আজও ‘উপেক্ষিত’, যার কারণে, অসতর্কতার বলি হচ্ছে বহু মানুষ! অন্যদিকে, এই প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাটি ক্রমশ বিপর্যয়ের রূপ ধারণ করছে।
একটু ক্ষয়ক্ষতির হিসেবের দিকে চোখ দিলেই দেখা যাচ্ছে যে, ভারতে প্রতি বৎসর প্রায় ২৫০০ লোক এই কারণে মারা যায়। বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা, ‘ডাউন টু আর্থ’ এর একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২৭৪৩ জন বজ্রপাতের বলি হয়েছে। একই সময়কালে আমেরিকায় মাত্র ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ভারত সহ দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে বজ্রপাতে মৃত্যু-হার বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে অত্যাধিক জনঘনত্ব, অসংগঠিত শ্রমিক ও এই সম্পর্কিত চরম অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন।
২০২০-২১ সালে ন্যাশন্যাল ক্রাইম রেকর্ড এর হিসেবে দেখা যাচ্ছে দুর্ঘটনাজনিত মোট মৃত্যুর ১৩ শতাংশই বজ্রপাতের কারনে ঘটেছে। অন্যদিকে, কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর একটি গবেষণায় উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ এর বেশি মানুষ বজ্রপাতে নিহত ও আহত হয়! যার বেশিরভাগই বিহার, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় বসবাসকারী অসংগঠিত কৃষি শ্রমিক। সি ই এস এস এর তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে মৃত ভারতবাসীর মধ্যে ৯৬ শতাংশই গ্রামে বসবাস করে।
বাংলাদেশকেও বজ্রপাত ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। প্রতি বছর বহু মানুষ এই বিপর্যয়ের স্বীকার হয়। আমেরিকার একটি সার্ভে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে , পৃথিবীর মোট বজ্রপাতে মৃত্যুর ১/৪ শতাংশ বাংলাদেশে ঘটে থাকে। কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ থমাশ স্নিডলিনের মতে সর্বোচ্চ বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ভারতের হিমালয় সন্নিহিত রাজ্যগুলিসহ গাঙ্গেয় পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশ বিভিন্ন অংশে। মৌসুমি সময়কালে, বিশেষত মে-জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এর প্রাদুর্ভাব থাকে। হিমালয়ের শুষ্ক শীতল বায়ু এবং দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে আগত আর্দ্র জলীয়বাষ্প পূর্ণ বায়ুর মিলনে এই সময় বজ্রগর্ভ মেঘের সৃষ্টি হয়। বর্তমান সময়কালে, কয়েক বছর আগের ভারতে তিনদিনে প্রায় ৩০০ মানুষ মারা যায় শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশ, বিহার ও মধ্যপ্রদেশে; যা এই বিপর্যয়ের ভয়াভয়তার দিক থেকে বিরলতম। এছাড়াও ২০২০ সালের ২৫ শে জুন বিহার (৯২) ও উত্তর প্রদেশে (২৪) কয়েক ঘন্টার মধ্যে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
১৯ শে জুলাই ২০২০, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া ও বর্ধমান জেলাতে মাত্র ২ ঘন্টায় ১১ জন মারা যায়। এই সব সত্বেও ভারতে এই বিষয়ে অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো সেইভাবে কোন পড়াশোনা বা গবেষণার ব্যাপকতা চোখে পড়ে নি।কেবলমাত্র পুনের IITM কিছুটা চেষ্টা করে চলেছে। বিজ্ঞানী সুনিল পাওয়ার হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে বজ্রপাতের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়ে চলায় অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে, সামাজিক স্তরে এই সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর আলোকপাত করেছেন।আর একটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয় যে, এই মৃত্যুর অধিকাংশই কৃষক, কৃষি শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক ও ছোট ব্যাবসার সাথে জড়িত মানুষ। ভারতের মতো কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়! সেই কারণে, সরকারিভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে, উপযুক্ত ব্যাবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এর ব্যাপকতা কিছুটা কমানো চেষ্টা করা আশু করণীয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিমিত বৃক্ষছেদন ইত্যাদি এর ব্যাপকতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও, গ্রামাঞ্চলে বট, তাল, নারকেল প্রভৃতি গাছ আজকাল অত্যন্ত ক্ষয়িষ্ণু। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির পর্যাপ্ত ব্যবহার, সর্বস্তরে মোবাইল ব্যবহার বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ। তবে এই বিপর্যয়ের থেকে পরিত্রাণের কয়েকটি উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে।
• কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা অন্তর তাল, খেজুর, সুপারি জাতীয় গাছ লাগালে প্রাণহানি কমবে।
• কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে সামাজিক স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।
• পরিকল্পনামাফিক বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো যেতে পারে, তবে এটা কিছুটা ব্যায়স্বাপেক্ষ।
• ব্জ্রপাত চলাকালীন করনীয় বিষয়গুলো প্রচার করতে হবে।
• খোলা মাঠে বা উচ্চ স্থানে থাকা যাবে না, পাকা বাড়িতে আশ্রয়ে ঝুঁকি কমে।
• উচ্চ গাছের তলা বা বিদ্যুৎ পোস্ট এর নীচে থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাই সতর্কতার সাথে এই বিষয়টি মেনে চলতে হবে।
• বজ্রপাতের সময় ঘরের জানালার কাছে থাকা সুরক্ষিত নয়।
• ধাতব কোনো বস্তর সংস্পর্শে আসা চলবে না।
• বিদ্যুৎ এর জিনিস এর ব্যবহার থেকে দুরে থাকতে হবে এবং বিদ্যুৎ চালিত জিনিসগুলির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা উচিত।
• গাড়ির মধ্যে থাকলে ধাতব বস্তু স্পর্শ করবেন না।
• ধানক্ষেত বা মাঠে থাকলে বজ্রপাতের সময় নীচু হয়ে বসে পড়ুন, শুয়ে পড়বেন না।
• বজ্রপাতের সময় বাড়ির ছাদে থাকবেন না।
• জলাশয় এর পাশে থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক কারণ জল বিদ্যুৎ পরিবাহী।
• একসাথে বেশি লোক এক জায়গায় না থাকাই শ্রেয়।
• ভিজা পায়ে বা খালি পায়ে থাকায় বিপদ হতে পারে, তাই রাবারের জুতো পরে থাকুন।
• বাড়িতে বজ্রনিরোধক লাগানো যেতে পারে,তবে তা দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে লাগাবেন, কারন লাগানোর ক্ষেত্রে ভুল হলে বজ্রপাতের প্রবনতা বাড়িয়ে দেয়।
• বাড়ির চারপাশে নারকেল গাছ লাগালে বাড়ি সুরক্ষিত থাকে।
• বজ্রপাতে আহতদের বিদ্যুৎ- পৃষ্ঠদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে।
• বজ্রপাতে আহত ব্যাক্তিদের তৎক্ষনাৎ স্পর্শ করবেন না।
• সামাজিক স্তরে আহতদের চিকিৎসার প্রসিক্ষন দেওয়া যেতে পারে,ফলে মৃত্যুর হার কিছুটা কমবে বলে আসা করা যায়।
পরিশেষে এটাই আবেদন, ভারতের মতো কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশে বজ্রপাতজনিত কারণে কৃষকদের অকালমৃত্যু কমানোর জন্য সরকারিভাবে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে, এই প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাকে ভবিষ্যতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হোক। (লেখক : ভূগোল বিষয়ের শিক্ষক ও গবেষক)