দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ঝাড়গ্রাম, ১৬ এপ্রিল:কর্মই ধর্ম (Work is Worship)। পণ্ডিতেরা বলেন, কোনো কাজই ছোট নয়, যদি তা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়। সেই পথেরই পথিক হলেন ‘অরণ্য সুন্দরী’ ঝাড়গ্রামের এক শিক্ষক। ঝাড়গ্রাম শহরের বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিমির মল্লিক তাঁর প্রিয় স্কুল বাঁচাতে তেলেভাজার দোকান খুলে বসলেন! আর, সেই টাকা থেকেই মেটানো হল, তাঁর স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদের বেতন সহ অন্যান্য খরচ। আর এভাবেই, ঝাড়গ্রামের তিমির মল্লিক যেন সারা রাজ্যের কাছে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।

thebengalpost.net
তিমির‌বাবু’র সেই দোকান :

জানা যায়, অতিমারী আর লকডাউন আবহে তাঁর স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, কঠিন সেই পরিস্থিতিতে, অধিকাংশ অভিভাবকই স্কুলের নির্ধারিত ফি-ও মেটাতে পারেননি! ফলে, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন মেটানো নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষক। ভার্চুয়াল বা অনলাইন ক্লাস চালু করেও লাভ হয়নি। কারণ, অধিকাংশ পরিবারেই স্মার্টফোন না থাকায় পড়ুয়ারা অংশগ্রহণ করতে পারেনি সেই ক্লাসগুলিতে। বরং, অনলাইন ক্লাসের জন্য শিক্ষিকাদের মোবাইলে রিচার্জ করে দিতে হয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। এই অবস্থায়, তেলেভাজা এবং মিষ্টির দোকান শুরু করেন প্রধান শিক্ষক তিমির মল্লিক। ঝাড়গ্রাম ব্লকের বাঁধগোড়া পঞ্চায়েতের পুরুষোত্তমপুরে নিজের তিন কাঠা জমিতে, ২০২০’র সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করেন তাঁর এই দোকান।

thebengalpost.net
অতিমারীর সময় শুরু করেছিলেন স্বল্প পরিসরে :

বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর তিমির বাবু’র সেই চপ-মিষ্টির দোকান গত দেড় বছর যাবৎ ভালই চলছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, সেই লাভের টাকাতেই নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন ১৫ জন শিক্ষিকা ও ৬ জন শিক্ষাকর্মীও। জানা গিয়েছে যে, একসময় নিজেই চপ-সিঙাড়া ভাজতে শুরু করেন তিমির। আর, এখন তাঁকে এই কাজ করতে দেখে এগিয়ে আসেন স্কুলের শিক্ষাকর্মী সন্দীপনারায়ণ দেব, অর্পণ নন্দ, শ্যামল দোলুই, কল্পনা সিংহ, দুর্গা দে-রাও। এমনকি, আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারাও বর্তমানে এই দোকানের নিয়মিত খদ্দের। সকালে ইডলি, হিংয়ের কচুরি, ঘুগনি, চা, আলুর চপ মিললেও বিকেল নাগাদ থাকে আরও রকমারি সব খাওয়ারের সম্ভার। ভেজিটেবল চপ, ডিমের চপ, এগ চাউমিন, চিকেন চাউমিন, চিকেন কাটলেট, সিঙ্গাড়াও থাকে সেই তালিকায়। তার সাথে থাকে মিষ্টির সম্ভারও। রসগোল্লা, পান্তুয়া, গজা, মিষ্টি দই সবই পাওয়া যায় তাঁর “স্পার্ক ২০২০” নামের ওই দোকানে। প্রধান শিক্ষক তিমির মল্লিক জানিয়েছেন, “করোনার সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রমাণ হিসেবেই আমি দোকানের এই নাম দিয়েছি। তবে, শুধু চপশিল্প কেন, নিষ্ঠাভরে যে কোনও কাজ করলেই সাফল্য আসে। যা মূলধন ছিল তাতে বড়জোর দু’মাস শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন মেটানো যেত। তার পরে কী হবে ভেবেই চপ-মিষ্টির দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিই।” স্কুল চালানোর জন্য তাঁর এই উদ্যোগকে কুর্ণিশ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। বর্তমানে, তিমির বাবু’র স্বপ্ন দোকান লাগোয়া জমিতে আগামী দিনে আদিবাসী-মূলবাসী শিশুদের জন্য একটি অবৈতনিক স্কুল খোলা। কর্ম-কেই যিনি ‘ধর্ম’ করেন, তিনি যে সকল ‘তিমির’ ঘুচিয়ে এভাবেই আলো ছড়িয়ে দেবেন সমাজে, তা এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন আপামর ঝাড়গ্রাম বাসী!