দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৫ ফেব্রুয়ারি: ১২৪-তম বার্ষিক উরস উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশের রাজবাড়ি থেকে পুণ্যার্থীদের নিয়ে বিশেষ ‘মৈত্রী’ ট্রেন এবার আর আসছে না মেদিনীপুর শহরে। শহরের জোড়া মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রতিবছর ৪ঠা ফাল্গুন অনুষ্ঠিত বার্ষিক ‘উরস’ (Urs) উপলক্ষে ১৯০২ সাল থেকে এই বিশেষ ট্রেন পুণ্যার্থীদের নিয়ে আসে মেদিনীপুরে। ট্রেনে আসেন বাংলাদেশের প্রায় ২ হাজার পুণ্যার্থী। লটারির মাধ্যমে তাঁদের বেছে নেয় বাংলাদেশের আঞ্জুমন-ই-কাদরী কমিটি। ফলে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মেদিনীপুর শহরের এই জোড়া মসজিদ প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে দুই বাংলার মিলনস্থল। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির জন্য তাতেই এবার ছন্দপতন হল! এবার রাজবাড়ির ট্রেন আসবেনা মেদিনীপুরে। এই নিয়ে পাঁচ বার ঘটল এমনটা। ১৯৬৫ ও ১৯৭১-এ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য এবং ২০২১ ও ২০২২-এ করোনা পরিস্থিতির জন্য ট্রেন আসেনি।

দেশের সম্মান ও নিরাপত্তার স্বার্থে ট্রেন না আসার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েও, নিজেদের ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন শহর মেদিনীপুরের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, মাত্র দু’দিনের (৩ ফাল্গুন ও ৪ ফাল্গুন) জন্য বিশেষ ট্রেনে করে আসেন প্রায় দু’হাজার পুণ্যার্থী। তবে, আরও দু’দিন আগে থেকে অর্থাৎ ১ ফাল্গুন থেকেই বাসে, বিমানে করেও আরও হাজার খানেক পুণ্যার্থী আসেন আন্তর্জাতিক এই উৎসব উপলক্ষে। আর তাঁরা মেদিনীপুর শহর থেকে ক্ষীরের গজা সহ নানা ধরনের মিষ্টি, নানা ধরনের মশলাপাতি, অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র, মাদুর, বাতাসা, নকুলদানা, জামাকাপড় প্রভৃতি কিনে নিয়ে যান। শুধু ১০০ কুইন্টাল ক্ষীরের গজাই বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন জেলার মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির অন্যতম সদস্য তথা মেদিনীপুর শহরের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সৌম্যদীপ গুহ, স্বপন কুন্ডুরা। তাঁরা বলেন, ক্ষীরের গজা ছাড়াও কালোজাম, ল্যাংচা, মিহিদানা প্রভৃতি কুইন্টাল কুইন্টাল বিক্রি হয়। শহরের জোড়া মসজিদ সংলগ্ন এলাকার মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা এবার লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করা থেকে বঞ্চিত হবেন বলেও তারা জানিয়েছেন। ছোট-বড় সব মিলিয়ে মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ টাকা বা আরও বেশি বলে জানিয়েছেন তাঁরা। ঠিক এভাবেই শহরের মিঞাবাজার, নিমতলাচক, নান্নুরচক, স্কুলবাজার এলাকার ভূষিমাল ও অ্যালুমিনিয়াম ব্যবসায়ীরাও জানান, এ ক’দিনে (সর্বাধিক ৫-৭ দিনে) গড়ে তাঁদের ১-২ লক্ষ টাকার ব্যবসা হয়। এছাড়াও, এই ক’দিন তাঁদের থাকা-খাওয়া, উরস মেলায় নানা ধরনের কেনাকাটা সহ প্রায় ২০-২৫ কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে জানিয়েছেন মেলা কমিটির সদস্য আব্দুল ওয়াহেদ। তিনি বলেন, “মেদিনীপুরের অর্থনীতিতে একটা বড় আঘাত। তবে, প্রশাসনের সিদ্ধান্ত সবার আগে। আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। মেলা আগের মতই হবে। তবে, কেনাকাটা এবার অনেক কম হবে তা বোঝাই যাচ্ছে।” মেদিনীপুর শহরের ব্যবসায়ী পি.কে মাহাত, তরুণ দে, শ্যামল কুমার দত্তরা বলেন, “এটা ঠিক আমাদের অনেক ক্ষতি হবে! তবে, ওদেরও একটা শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিল।”
কংগ্রেস নেতা শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির জন্য আমরা দুঃখিত। আমরা চাই দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক। তবে, এটাও ঠিক, যে দেশকে আমরা জন্ম দিয়েছি; তাদের অহং, অত্যাচার মেনে নেওয়া যায় না। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরাও স্বাগত জানাই।” মেদিনীপুরের বিধায়ক সুজয় হাজরা বলেন, “উরসকে কেন্দ্র করে দুই বাংলার মিলনস্থল হয়ে ওঠে মেদিনীপুর। এবার বাংলাদেশের ট্রেন আসবে না। আমরা দুঃখিত! কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন আমাদের রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশা করবো, পরের বছর আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে।” প্রসঙ্গত, ‘মাওলা পাক’ হজরত সৈয়দ শাহ মুর্শেদ আলি আল কাদেরির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে এই উরস পালিত হয়। হজরত মহম্মদের ৩৩-তম বংশধর এবং সুফি সাধনার আদিগুরু ‘বড় পীর সাহেব’ হজরত আব্দুল কাদের জিলানির ১৯-তম বংশধর মাওলা পাক ৪ ফাল্গুন প্রয়াত হন। ওই দিন দেশ-বিদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের গুরুকে স্মরণ করেন। ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে বিশেষ ট্রেনে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা মেদিনীপুরের পবিত্র জোড়া মসজিদ প্রাঙ্গণে আসেন বড় হুজুর মাওলা পাকের উরস উপলক্ষে। ১৯০২ সাল থেকে সেই উপলক্ষেই এই বিশেষ মৈত্রী ট্রেন বাংলাদেশ থেকে আসে মেদিনীপুর শহরে। এবারও ৪ঠা ফাল্গুন, সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে ‘বড় হুজুর’ মাওলা পাকের বার্ষিক উরস মেলা অনুষ্ঠিত হবে। সেই উপলক্ষে সেজে উঠেছে জোড়া মসজিদ প্রাঙ্গণ। শুক্রবার (১ ফাল্গুন) থেকে মেলাও শুরু হয়েছে। চলবে ১৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার পর্যন্ত। বাংলাদেশের পুণ্যার্থীরা না এলেও, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৫০-৬০ হাজার পুণ্যার্থী আসতে পারেন ১৬ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি। এমনটাই জানিয়েছেন উরস কমিটির সদস্য সৈয়দ মেহেজুজ আলি।