দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ সেপ্টেম্বর: ‘নেশা’ করার প্রতিবাদ করায় ভাইয়ের হাতে খুন হতে হয়েছিল দাদাকে! পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর পৌরসভার ৩৩ নং ওয়ার্ডের রবীন্দ্রপল্লী এলাকায় রবিবার ঘটেছিল এই মর্মান্তিক ঘটনাটি। মৃত দাদা জি. নভজিৎ রাও (ভক্তি রাও) এর মেজ ভাই জি. সুমন রাও ওই দিন রাতে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে দাঁড়িয়ে জানিয়েছিলেন, “আমাদের ছোট ভাই সুমিত সবসময় গাঁজা-র নেশা করত! এর আগেও ওকে নিয়ে অশান্তি হয়েছে। বাড়িতে ওকে খুঁজে পুলিশ পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু, ও শুধরায়নি। রবিবার দুপুরেও বাড়ির ভেতরে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে নেশা করছিল। আমি আর আমার দাদা প্রতিবাদ করি। বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিই। সেই রাগেই ফুঁসছিল ও! বলছিল আমি আসছি, তোদের দেখে নেব! এর কিছুক্ষণ পর একটা বাইক নিয়ে ফিরে আসে। কিছু সময় পর, সেই বাইকটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভান করে। সেই সময় আমার দাদা বাড়ির উঠোনে বসে বসে মুরগি-কে খাওয়ার খাওয়াচ্ছিল। ও ওই টুকুর মধ্যেই বাইকের তীব্র গতিবেগ বাড়িয়ে দাদার পেছনে ধাক্কা মারে! দাদা ছিটকে গিয়ে কংক্রিটের রাস্তার উপর পড়ে। মাথায় আঘাত লাগে। কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যায়!” তারপরই প্রথমে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় নভজিৎ-কে। সেখান থেকে সন্ধ্যা নাগাদ রেফার করা হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ রাত্রি ৮ টা নাগাদ বছর ৪৫ এর নভজিৎ রাওয়ের মৃত্যু হয়! এই ঘটনায় স্থানীয়দের সহায়তায়, ওই দিন রাতেই ঘাতক বাইক সমেত সুমিত-কে আটক করে খড়্গপুর গ্রামীণ থানার পুলিশ। এদিকে ঘটনার মোড় নেয় অন্যদিকে! জানা যায়, মাদক কারবারে বাধা দেওয়াতেই ‘খুন’ হতে হয়েছে নভজিৎ ওরফে ভক্তি-কে। এই মাদকচক্রের প্রধান পান্ডা সেখ আনোয়ারের হদিস পায় পুলিশ। জানা যায়, ঘাতক বাইকটি এই আনোয়ারেরই। সোমবার তাকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের পর সুমিত এবং আনোয়ার ২ জনকেই গ্রেপ্তার করেছে লোকাল থানার পুলিশ। মঙ্গলবার তাদের আদালতে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন লোকাল থানার পুলিশ আধিকারিক। একইসাথে, এই চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে আরও ৩ জনের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।
তিন ভাইয়ের সংসারে বড় দাদা নভজিৎ ওরফে ভক্তি-ই ছিল সংসারের কান্ডারী। খড়্গপুর আইআইটি চত্বরে টেক মার্কেটে ইডলি-ধোসার দোকান ছিল তাঁর। মেজ ভাই সুমনের ছিল ভুসিমাল দোকান। কিন্তু, বছর ৩০ এর ছোট ভাই নেশা করেই ঘুরে বেড়াতো। আসতে আসতে এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে! যা নিয়ে সংসারে ছিল তীব্র অশান্তি। বাড়িতে একাধিকবার সুমিতের খোঁজে পুলিশ-ও এসেছে। তাতে নেশাগ্রস্ত সুমিতের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শেষমেশ প্রতিবাদ করায় চিরতরে প্রাণ যায় নিরীহ দাদারই! মেজ ভাই সুমন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে দাঁড়িয়ে কড়া শাস্তির দাবি করল- “ও যেন চরম শাস্তি পায়। ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হয়। এরকম ভাই সংসারে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো!” সুমন জোয়ালা-নামে এক মাদক কারবারির নামও নিয়েছিল। সেই গ্রেপ্তার হওয়া আনোয়ার কিনা বা গা ঢাকা দেওয়া অন্য অপরাধী কিনা, তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। একইসঙ্গে এই মাদক চক্রে যুক্ত থাকা আরও তিনজনকে খুঁজছে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত তাদের পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে পুলিশ সূত্রে। খড়্গপুর এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রানা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমাদের ধারণা খুনের উদ্দেশ্য নিয়েই বাইকের ধাক্কা মেরে ছিল ওই যুবক। বাইকের মালিক এবং ওই যুবককে (মৃতের ভাই সুমিত রাও) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত আরও তিনজনের নাম পেয়েছি। সকলকেই গ্রেফতার করা হবে।” রবীন্দ্রপল্লী এলাকার সিপিআই নেতা আয়ুব আলী জানিয়েছেন, “সুমিত যার বাইক ব্যবহার করেছিল, সেই শেখ আনোয়ার মাদকচক্রের পান্ডা। আরো তিনজন যুবক আছে। পুলিশ পদক্ষেপ করুক।” এদিকে, এই ঘটনার পর মেদিনীপুর সহ সারা জেলা জুড়েই বেআইনি মদ, গাঁজা, চরস, হেরোইন প্রভৃতি কারবারে যুক্ত অপরাধীদের গ্রেফতার করার দাবি তুলেছে এলাকাবাসী। সোমবার সন্ধ্যাতেই জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “অবৈধ চোলাইয়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান চলবে। অন্যান্য মাদকচক্রের বিরুদ্ধেও সুস্পষ্ট অভিযোগ বা প্রমাণ পাওয়া গেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশও অভিযান চালাবে।” এদিকে, নভজিৎ এর মেয়ে হলদিয়ার একটি নামকরা কলেজে মেডিক্যাল পড়ছে। ছেলেও এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হবে। সব মিলিয়ে নেশাগ্রস্ত ভাইয়ের নিষ্ঠুরতায় দাদার সংসার এখন অথৈ জলে!