দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, নীলোৎপল চ্যাটার্জি (মেদিনীপুর), ২৪ এপ্রিল: দাহ নয়, ‘দেহদান’-ই করা হল আমাদের সকলের প্রিয় টিটো দা’র! হ্যাঁ, জেলা শহর মেদিনীপুরের সংস্কৃতিমনা, নাট্যকর্মী, গায়ক, পশুপ্রেমী তথা সকলের প্রিয় সম্ভ্রম চক্রবর্তী-কে টিটো নামেই চিনতেন আপামর মেদিনীপুরবাসী। শনিবার সন্ধ্যাতেও টিটো দা অক্সিজেন পৌঁছে দিয়েছেন মুমূর্ষ রোগীর বাড়িতে। তার আগে, খড়্গপুরের বেনাপুরে গিয়েছিলেন নিজের কাজে। সেখান থেকেও ফোনে অন্তত ৪০-৪৫ মিনিট কথা হয়েছে আমার সাথে। তার কয়কেঘন্টা পর একজনের বাড়িতে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়ে, নিজের বাড়ি পৌঁছেছিলেন টিটো দা। মুখ-হাত ধুয়ে, খাওয়া-দাওয়ার কিছুক্ষণ পরই, পর পর বমি শুরু হয়। তখনই হয়তো ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গিয়েছিল! সঙ্গে সঙ্গেই খবর দেওয়া হয় শহরের কেরানীচটিতে তাঁর দিদি-জামাইবাবু (শতাব্দী গোস্বামী চক্রবর্তী এবং শিবু গোস্বামী)-কে। শিবুদা গাড়ি নিয়ে রাত্রি দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ শহরের বক্সীবাজারের বাড়িতে পৌঁছে, প্রায় অচৈতন্য টিটো দা-কে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে স্পন্দন হাসপাতাল, তারপর মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু, ঈশ্বর যে এত নিষ্ঠুর হতে পারেন, তা বোধহয় আমরা কেউই বুঝতে পারিনি! শেষ রক্ষা হল না! রাত্রি দেড়টা নাগাদ আমাদের সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন টিটো দা! আমি অবশ্য তখনো খবর পাইনি। দুঃসংবাদটা পেলাম ভোর ৫ টা নাগাদ! তখন থেকে সারাদিন কাটল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেই। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, নিজেকে মানুষ তথা অবলা পশুদের জন্য বিলিয়ে দেওয়া, টিটো দার দেহ দান (মরণোত্তর দেহদান) করা হবে। তাই হল। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে টিটো দা-কে একলা রেখে আমরা ফিরে এলাম!
আসলে, আপামর মেদিনীপুরবাসীর খেয়াল রাখা টিটো দা নিজের শরীরের খেয়াল কোনদিনই রাখতেন না। আমি একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে যেটুকু বুজেছি, টিটো দা’র প্রেসার একটু হাই বা বেশি ছিল! কিন্তু, কে শোনে কার কথা! নিজে হোমিওপ্যাথি’র সঙ্গে যুক্ত থাকায় (বটতলায় হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান, স্ত্রী নবীনা চক্রবর্তী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক), অ্যালোপ্যাথি-কে যেন গুরুত্ব দিতেই চাইতেন না! যাই হোক, চিকিৎসকদের মতে সেরিব্রাল অ্যাটাক (ব্রেন স্ট্রোক) এবং তারপর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হৃদযন্ত্র বিকল হওয়া) এর কথা বলা হচ্ছে। তবে, সবটাই ছিল আমাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই। একজন প্রতিভাবান অভিনেতা, গায়ক, শিল্পী এবং পরোপকারী যুবকের মৃত্যুশোক মেদিনীপুরের কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। জানিনা, টিটোদার প্রিয় বোবো বা তরী (বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতনের ক্লাস সেভেনের ছাত্রী)-র কাছে আমরা সবাই কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবো। বাবার মতোই সুন্দর গান গাইতো। ইউটিউব খুললেই, ‘বাবা মেয়ের গান’! ‘তোমাকে’ নিয়ে কি বলব, কিভাবে বলব বুঝতে পারছিনা, “আমার ‘লকডাউন’ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে কি অসামান্য অভিনয় তুমি করেছিলে টিটো দা! প্রতিবছরের মতো এবারও মেদিনীপুর কলেজের প্রাক্তনীদের অনুষ্ঠানের নাটকে অনবদ্য অভিনয়। পথ কুকুরদের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা! দাদা-দিদি, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবদের বিপদে-আপদে কেউ থাকুক না থাকুক, তুমি ঠিক থাকতে! মেদিনীপুর তোমায় কি করে ভুলবে টিটো দা! কাকু (সংস্কৃতিমনষ্ক, বাম কর্মী প্রণব চক্রবর্তী/ জেমুদা), কাকিমা (শিক্ষিকা রেবা চক্রবর্তী), বৌদি (চিকিৎসক নবীনা চক্রবর্তী), শতাব্দী দি (নৃত্যশিল্পী শতাব্দী গোস্বামী চক্রবর্তী), শিবু দা- সকলেই হয়তো একদিন শোক কাটিয়ে উঠবেন! কিন্তু, তোমার বোবো? ‘বাবা-মেয়ের গান’ আর তো হবেনা! এটা তুমি ঠিক করলেনা টিটো দা! মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই, কিসের এতো তাড়া ছিল তোমার? এই নিষ্ঠুর পৃথিবী সত্যি কি তোমার মত প্রেমিক আর নিঃস্বার্থপর মানুষদের জন্য নয়? তাই হয়তো হবে! ‘হৃদয় খুঁড়ে আর বেদনা জাগাতে’ পারছিনা টিটো দা! তুমি ভালো থেকো। যেখানেই থাকো ভালো থাকো।”