দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ জুন: দাঁতনের (পশ্চিম মেদিনীপুর) প্রত্যন্ত খন্ডরুইয়ের বাসিন্দা দ্বারিকেশ পট্টনায়েক ২৮ বছর ধরে বাড়ির বাইরে। মুম্বাই থেকে বাহরিন, সেখান থেকে কুয়েত। কুয়েতের NBTC সংস্থাতেই চাকরি গত ২০ বছর ধরে। ভালো পদেও (সুপারভাইজার) ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মাইনেও খারাপ পেতেন না! তবে, কাজের চাপও ছিল খুব। প্রতি বছর বাড়ি ফিরতেন এপ্রিল মাসে। ২০২৩ সালেও তাই এসেছিলেন। এর মধ্যেই, একমাত্র মেয়ে ঐশীর পড়াশোনার স্বার্থে বছর পাঁচেক আগে মেদিনীপুর শহরে (শরৎপল্লীতে) জায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন। যদিও, ধাপে ধাপেই চলছিল তিন তলা সেই বাড়ি তৈরির কাজ। গত বছরও (২০২৩) যখন পশ্চিম মেদিনীপুরে এসেছিলেন, সাধের সেই বাড়ি সম্পূর্ণ হয়নি। আশা করেছিলেন, চব্বিশ সালে (২০২৪-এ) তিনি আসার আগেই তাঁর সাধের বাড়ি মনের মতো প্রস্তুত হয়ে যাবে বা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। সেই মতো স্ত্রী, শ্যালক (সায়ন্তন পট্টনায়েক) সহ পরিজনদের নির্দেশ দিয়েও গিয়েছিলেন। অবশ্য ফোনে প্রতিদিনই তাঁদের সঙ্গে কথা হতো। সেই ফোনেই জেনে গিয়েছিলেন, বাড়ির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। এদিকে দ্বারিকেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এবার আর এপ্রিল নয়; মেয়েের জন্মদিন আর দুর্গা পুজো উপলক্ষে অক্টোবরে বাড়ি আসবেন। সেই মতোই প্রস্ততিও নিচ্ছিলেন। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তার আগেই অবশ্য বাড়ি ফিরতে হল দ্বারিকেশ-কে! তবে, ‘কফিনবন্দী’ হয়ে!
প্রথমে ভারত সরকার এবং পরে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কুয়েতের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত একমাত্র বাঙালি দ্বারিকেশ পট্টনায়েকের নিথর দেহ শনিবার (১৫ জুন) সকাল ১১টা নাগাদ কুয়েত থেকে কফিনবন্দী হয়ে মেদিনীপুর শহরের শরৎপল্লীতে পৌঁছয়। অষ্টমীর দিন মেয়ের ১৮-তম জন্মদিন উপলক্ষে যাঁর খুশিমনে পৌঁছনোর কথা ছিল সাধের বাড়িতে, সেই কিনা এলো এমন বেশে! শোকে, কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিজনেরা। স্ত্রী অন্তরা, মেয়ে ঐশী বুধবার থেকেই (১২ জুন, অগ্নিকাণ্ডের খবর শোনার পর থেকেই) সব হারানোর শোকে মুহ্যমান! জ্ঞান হারাচ্ছেন বার বার। তাঁদের পাশে থাকতে দাঁতন থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন আত্মীয়-পরিজনেরা। তাঁদের চোখের জলও বাঁধ মানেনি এক মুহূর্তের জন্য! দলমত নির্বিশেষে শহরের শতাধিক মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরাও মেদিনীপুর শহরের বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ছিলেন মেদিনীপুরের নব-নির্বাচিত সাংসদ জুন মালিয়া থেকে তৃণমূলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা, শহর সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডব, পৌরপ্রধান সৌমেন খান, বিজেপি-র জেলা সাধারণ সম্পাদক শুভজিৎ রায়, সহ-সভাপতি রমাপ্রসাদ গিরি, শঙ্কর গুছাইত, অরূপ দাস প্রমুখ।
বেলা ১২টা নাগাদ মেদিনীপুর শহরের বাড়ি থেকে দ্বারিকেশের দেহ নিয়ে খন্ডরুইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় রাজ্য পুলিশের কনভয়। বেলা ১টা নাগাদ খন্ডরুই গ্রামে পৌঁছে যায় দ্বারিকেশের দেহ! শেষ বিদায় জানানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন গ্রামের অগণিত মানুষ। দ্বারিকেশের শ্বশুরবাড়িও দাঁতনের তুরকা অঞ্চলেই। শ্বশুর কমলাকান্ত পট্টনায়েক আবার অঞ্চল তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি। যদিও, আত্মীয়বৎসল ও পরোপকারী দ্বারিকেশের শেষ যাত্রায় দলমত নির্বিশেষে সকলেই উপস্থিত হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সাংসদ জুন মালিয়া কনভয়ের সঙ্গেই দাঁতনে পৌঁছেছেন। ছিলেন বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধান থেকে ব্লক তৃণমূল নেতৃত্ব-ও। বিজেপি-র নেতৃত্বরাও উপস্থিত ছিলেন। বিকেল ৪টা নাগাদ দ্বারিকেশের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়! প্রতিবেশী ও পরিজনেরা বলেন, বছরে একবার আসতেন ঠিকই কিন্তু গ্রামের সকলকেই খুব ভালোবাসতেন। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন আবদারও মিটিয়েছেন। সাধ্যমত দান-ধ্যানও করতেন দ্বারিকেশ। আর সেজন্যই বোধহয় সুদূর কুয়েতে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও, নিজের গ্রামে হাজার-হাজার মানুষের উপস্থিতিতে, শোকে-বিহ্বলতায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল!