মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩০ আগস্ট: বাবাও ছিলেন প্রধান শিক্ষক। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছেন, জাতির ‘মেরুদন্ড’ স্বরূপ শিক্ষকদের কাজ শুধু পুঁথিগত শিক্ষা প্রদান বা পাঠদান করাই নয়; পরিবেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে, কচিকাঁচাদের ‘মানুষের মত মানুষ’ হয়ে উঠতে সাহায্য করা! বাবার দেখানো পথে সেই কাজটাই করে চলেছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক তথা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর গ্রামীণের (খড়্গপুর ২নং ব্লকের) বেনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমন রায়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একমাত্র শিক্ষক হিসেবে এবার তিনিই পাচ্ছেন রাজ্য সরকারের ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কার (Shiksharatna Award 2024)। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট)-ই ‘সুখবর’ এসে পৌঁছেছে বেনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমন রায়ের কাছে। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ শিক্ষক দিবসের দিন রাজ্য সরকারের তরফে তাঁকে ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মানে ভূষিত করা হবে।

thebengalpost.net
সুমন রায়:

শহর মেদিনীপুরের বাসিন্দা সুমন রায় এর আগে টানা ১৪ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর ব্লকের সাহসপুর ঘোষাল উচ্চ বিদ্যালয়ে। বছর দশেক আগে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগদান করেন খড়্গপুর ২নং ব্লকের বেনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এলাকায় নানা সমাজসেবামূলক কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। করোনাকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাহায্যে বিশেষ তহবিল গড়ে আশেপাশের ১১টি গ্রামে থার্মোমিটার, মাস্ক, স্যানিটাইজার বিলি করেছেন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে। এছাড়াও, গত বছর (২০২৩) ২৬ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ ‘বীরসিংহের সিংহশিশু’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৪তম জন্মজয়ন্তীতে বিদ্যালয়ের কন্যাশ্রী ক্লাবের ছাত্রীদের নিয়ে গিয়ে বীরসিংহ (পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার) থেকে পবিত্র মাটি সংগ্রহ করে, বিদ্যালয় সংলগ্ন ১১টি গ্রামে ‘বটবৃক্ষ’ রোপন করছেন প্রধান শিক্ষক সুমন রায়। শুধু তাই নয়, নবজাগরণের অগ্রদূত তথা ‘নারী শিক্ষার পথিকৃৎ’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অমর কীর্তি স্মরণে রেখে প্রত্যন্ত ওই গ্রামগুলিতে নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রধান শিক্ষকের এই ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন এলাকাবাসী এবং ছাত্র-ছাত্রীরাও। প্রধান শিক্ষক সুমন রায়ের এমনই সব অসামান্য কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এবার তাঁকে ‘শিক্ষারত্ন’ পুরস্কারের জন্য বেছে নিয়েছে রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুমন বাবু এই বিষয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেন, “একটি সুন্দর স্কুল গড়ে তোলার পাশাপাশি, একটি সুস্থ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করাই আমাদের স্বপ্ন। শিক্ষক কিংবা প্রধান শিক্ষক হিসেব সেই কাজ যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করে গেছি। প্রতি মুহূর্তে সহযোগিতা পেয়েছি আমার সহকর্মী তথা অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং এলাকাবাসীদের। রাজ্য সরকারের প্রতিও আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের জন্য আমাকে বেছে নেওয়ার জন্য।” তিনি এও জানা, ‘জাতীয় শিক্ষক’ ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিনে অর্থাৎ আগামী ৫ সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবসের দিন কলকাতার বিশ্ববাংলা মেলা প্রাঙ্গণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেবেন। সাম্প্রতিক আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদেও তাঁর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সামিল হয়েছিল বলে জানান সুমন। বিদ্যালয় ছুটির পর ছাত্র-ছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকরা সুবিচারের দাবিতে, প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি হাতে মৌন মিছিল করেছিলেন বলে জানান তিনি। এই বিষয়ে ‘শিক্ষারত্ন’ সুমনের আবেদন, “যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে সরকার তথা প্রশাসনকে আরো যত্নশীল বা দায়িত্বশীল হওয়ার আবেদন জানাব। সেইসঙ্গে, আমাদের সকলকেই হাতে হাত মিলিয়ে একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরও আন্তরিক হতে হবে। ছোট থেকেই ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষা বা নীতি শিক্ষা দেওয়ার খুব প্রয়োজন। শিক্ষকদের পাশাপাশি পরিবারকেও সেই দায়িত্ব সমানভাবে পালন করতে হবে।”

thebengalpost.net
বেনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়: