মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৭ সেপ্টেম্বর:”এখানে আমাকে নাটক, চলচ্চিত্রের সমালোচক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এতে আমার একটু আপত্তি আছে! আমি শিক্ষকের পুত্র। শিক্ষকতা করতেই চেয়েছিলাম। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি বেশ কয়েক বছর। তারপর উপলব্ধি করলাম, পরিবেশ বড্ড দূষিত হয়ে উঠেছে। শিক্ষকতার পথ পঙ্কিল হয়ে উঠেছে! চাকরি ছেড়ে তাই নতুন একটা জগতে এলাম।…যে জগতে আমি বিদগ্ধজনেদের নানা সৃষ্টি, আমার অন্তরের সমস্ত চেতনা দিয়ে সম্পূর্ণ (সমৃদ্ধ) করে তোলার চেষ্টা করি। নিজেকে আমি তাই বই তৈরির মিস্ত্রি বলে পরিচয় দিই।” মেদিনীপুরের ‘বীর সন্তান’ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৫-তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) তাঁরই নামাঙ্কিত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় (Vidyasagar University) আয়োজিত ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানের মঞ্চে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে যিনি দৃপ্ত কন্ঠে এই কথাগুলি উচ্চারণ করেন; তিনি একাধারে চলচ্চিত্র, থিয়েটার, সাহিত্য সমালোচক থেকে অভিধান রচয়িতা, প্রকাশক ও সম্পাদক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
উল্লেখ্য যে, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এবার (২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) যে তিন গুণী ব্যক্তিত্বের হাতে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ তুলে দেওয়া হয়, বর্ষীয়ান লেখক, সমালোচক ও প্রকাশক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’-এ ভূষিত অপর দুই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেন, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সমাজসেবা ও মানব কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ তথা বেলপাহাড়ি রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী রামাত্মনন্দ মহারাজ এবং ঝাড়গ্রামের ‘কোকিলকণ্ঠী’ ঝুমুর শিল্পী তথা ‘জঙ্গলমহলের নাইটেঙ্গল’ হিসেবে সুপরিচিত ইন্দ্রানী মাহাত। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দ সভাগৃহে এক মর্যাদাপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই তিন গুণীজনের হাতে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী। পুরস্কার স্বরূপ তাঁদের হাতে অর্পন করা হয় মানপত্র, উত্তরীয় বা শাল, বিদ্যাসাগর রচনাবলী এবং ২৫ হাজার অর্থমূল্যের চেক। পুরস্কার প্রাপক এই তিন গুণী মানুষই ‘নবজাগরণের অগ্রদূত’ তথা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সম্মান, শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাঁর কবিতার সুরেই বলি, ‘রুদ্ধ ভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা।’ অর্থাৎ, বিদ্যাসাগর মহাশয় এক অন্ধকারময় অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার নব উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।”
ষষ্ঠ বিদ্যাসাগর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে স্বামী রামাত্মনন্দ মহারাজ বলেন, “বর্তমানে আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি। কিন্তু, বিজ্ঞান কি আমাদের মনুষ্যত্ব দিতে পেরেছে? সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারলেও, আত্মিক উন্নতি ঘটাতে পারেনি।” জঙ্গলমহল বেলপাহাড়ির শবর (বা, লোধা-শবর) সম্প্রদায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ সামগ্রিক জীবনধারার মানোন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ রামাত্মনন্দ মহারাজ তাই বিজ্ঞানের সাথে সাথেই মনুষ্যত্বের বিকাশ তথা আত্মিক উন্নতির বার্তা দেন। সেই সঙ্গে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কিভাবে ‘দয়ার সাগর’ ও ‘বিদ্যার সাগর’ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অন্তরাত্মা’-র বিকাশ সাধনে সহায়তা করেছিলেন, সেই ইতিহাসও তুলে ধরেন। জঙ্গলমহলের ‘নাইটেঙ্গল’ রূপে খ্যাত, ‘কোকিলকন্ঠী’ ঝুমুর শিল্পী ইন্দ্রানী মাহাত তাঁর কথা শুরু ও শেষ করেন ‘ঝুমুর’ গান দিয়েই। ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মতোই জঙ্গলমহলের বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ঝুমুর গানও যে সুমহান ঐতিহ্য বহন করে চলেছে, তা তাঁর ঝুমুর গানের মধ্য দিয়েই ব্যক্ত করেন ‘ঝুমুর সম্রাজ্ঞী’ ইন্দ্রানী। তিনি বলেন, গ্রাম বাংলার খেটেখাওয়া, দরিদ্র, শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষের প্রাণের সঙ্গীত হল ‘ঝুমুর’। কবি ভবতোষ শতপথীর সৃষ্টিতে নিজের অসামান্য কন্ঠ দান করে ইন্দ্রানী গেয়ে ওঠেন, “মরছা পড়া জীবনটাকে বেদম বাজাব…এক দু’কলি ঝুমুর শিখাই দে!” ‘রত্নগর্ভা’ মেদিনীপুরের মাটিতে ঈশ্বরের ২০৫-তম জন্মদিনে তাঁর নামাঙ্কিত পুরস্কার প্রদানের মঞ্চ থেকে লেখক, প্রকাশক ও সম্পাদক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক যেভাবে হাজার হাজার বইয়ের রূপকার ও সংগ্রাহক হিসেবে জ্ঞানের সার্থক বিকাশ আর উন্নত সমাজের কথা বলেন, স্বামী রামাত্মনন্দ মহারাজ বলেন আত্মিক উন্নতি সাধনের কথা; ঠিক সেভাবেই জঙ্গলমহল তথা লোকসংস্কৃতির অলঙ্কার স্বরূপ ঝুমুরের ঐতিহ্য রক্ষার বার্তা দেন ‘জঙ্গলমহলের গর্ব’ ইন্দ্রানী মাহাত।