মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১১ মে: বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। শৈশব থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র রূপায়ণ দে। তবে, হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়! পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় হারাতে হয় বাবা (শিবনাথ দে)-কে। যদিও, ঝড়ের আঁচ রূপায়ণের গায়ে লাগতে দেননি পিসি (পিসিমা) লতিকা দে! রূপায়ণের পড়াশোনা থেকে শুরু করে সমস্ত সখ-আহ্লাদ পূরণ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। পেশায় বিডিও অফিসের (গড়বেতা-৩নং ব্লকের) কর্মী লতিকা দেবী নিজে সংসার করেননি; রূপায়ণ আর তার মা (ঊষা দে)-কে নিয়েই তাঁর ছোট্ট সংসার! রূপায়ণ অবশ্য পিসি-কে নিরাশ করেনি। মাধ্যমিকে ৬৪৮ (৯২.৫৭ শতাংশ) নম্বর পাওয়ার পর, উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৮৬ নম্বর পেয়ে জেলায় (পশ্চিম মেদিনীপুরে) একবারে ‘প্রথম’ স্থান অর্জন করেছে মেদিনীপুর শহরের রাঙামাটির বাসিন্দা রূপায়ণ দে।
মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র রূপায়ণের প্রাপ্ত নম্বর ৪৮৬ (বেস্ট অফ ফাইভে)। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবার এটাই সর্বোচ্চ নম্বর। রূপায়ণ ‘গর্বিত’ করেছে মা, পিসি সহ নিজের পরিবার এবং স্কুলকে। যদিও, সকলের একটাই আফসোস! মাত্র ১ নম্বরের জন্য মেধাতালিকায় জায়গা হলোনা! উচ্চ মাধ্যমিকের ‘দশম’ স্থানাধিকারীদের নম্বর ৪৮৭। উল্লেখ্য যে, মেধাতালিকায় এবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেউই জায়গা করে নিতে পারেনি। ৪৮৬ নম্বর পেয়ে একাদশ তম (জেলায় প্রথম) স্থানে আছে ইকো-জিও-ম্যাথের স্টুডেন্ট রূপায়ণ। ছোট থেকেই ‘ক্যুইজ-পাগল’ রূপায়ণের সাবজেক্ট কম্বিনেশন কিছুটা অদ্ভুত! বিজ্ঞান, কলা আর বাণিজ্য শাখার মেলবন্ধন বলা চলে। বাংলা (৯৩), ইংরেজি (৯০) ছাড়া রূপায়ণের অন্যান্য বিষয় এবং সেগুলিতে প্রাপ্ত নম্বর হল যথাক্রমে- অর্থনীতি (১০০), ভূগোল (৯৯), গণিত (৯৬) এবং কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন (৯৮)। এরকম অদ্ভুত সাবজেক্ট কম্বিনেশন কেন? রূপায়ণ বলে, “ছোট থেকেই অঙ্ক আর ভূগোল বিষয় আমার খুব খুব ভালো লাগে। আর আমার লক্ষ্য ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ছিলোনা, আমি বরাবর UPSC-তে সফল হয়ে IAS (বা, IPS) হতে চেয়েছি। তাই, অঙ্ক ও ভূগোল বিষয় দু’টিকে সামনে রেখে একটি মিশ্র সাবজেক্ট কম্বিনেশন গড়ে নিতে হয়েছে স্কুলের শিক্ষক এবং গৃহ শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে।”
রূপায়ণ চায় IAS বা IPS হতে। সেই লক্ষ্যেই দিল্লি পাড়ি দিতে চায় সে। রূপায়ণ বলে, “আপাতত অল ইন্ডিয়া জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভাল র্যাঙ্ক করে (পরীক্ষা দিয়ছে, এখনও ফলাফল প্রকাশিত হয়নি) দিল্লির কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আরবান প্ল্যানিং টাউন প্ল্যানিং’ নিয়ে ভর্তি হতে চাইছি। সঙ্গে UPSC-র প্রস্তুতি নেব।” কিন্তু দিল্লি কেন? রূপায়ণ জানায়, পশ্চিমবঙ্গের কোনও কলেজে ‘আরবান প্ল্যানিং টাউন প্ল্যানিং’ পড়ানো হয়না। রূপায়ণ অর্থনীতিতে ১০০-য় ১০০ পেয়েছে, ভূগোলে পেয়েছে ৯৯। এজন্য, স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গেই নিজের প্রিয় গৃহ শিক্ষকদেরও কৃতিত্ব দিয়েছে সে। রূপম-কে অর্থনীতি পড়াতেন মেদিনীপুর শহরেরই শিক্ষক প্রবীর কুমার লায়েক। প্রবীর বাবু বলেন, “অত্যন্ত অনুগত, মনোযোগী ও মেধাবী ছাত্র। যা বলতাম শুনত। জানতাম খুব ভাল রেজাল্ট-ই করবে।” শুধু পড়াশোনা নয়, ক্যুইজ, অঙ্কন, বিভিন্ন ধরনের মডেল তৈরিতেও দক্ষ রূপায়ণ। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জিতে নিয়েছে অসংখ্য পুরস্কার। পিসি লতিকা দে বলেন, “ওর জন্য গর্বে বুকটা ভরে যায়! আমাদের সমস্ত পরিশ্রম স্বার্থক।” রূপায়ণের বাবা শিবনাথ দে-র ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা ছিল। মা ঊষা দে গৃহবধূ। তিনি বলেন, “ও যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় ওর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান! ওর পিসি ছিলেন বলেই হয়তো রূপায়ণ এত সুন্দর ভাবে এগোতে পারছে। ওকে নিয়েই তো এখন আমাদের সব স্বপ্ন, ভালোলাগা। মা হয়ে ঈশ্বরের কাছে শুধু এটুকুই চাইবো, ওর সব স্বপ্ন পূরণ হোক!” [সংযোজন- পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মেধাতালিকা: প্রথম- মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের রূপায়ণ দে (৪৮৬, বাণিজ্য শাখা); দ্বিতীয়- মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের পিনাকপাণি মণ্ডল (৪৮১, বিজ্ঞান শাখা); তৃতীয়- রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাভবন, মেদিনীপুরের দেবমাল্য নিয়োগী (৪৮০, বিজ্ঞান শাখা)।]