দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৬ জুলাই: মাত্র ১ সপ্তাহ আগেই ছেলেকে হোস্টেলে রেখে মেদিনীপুর শহরের বাড়িতে (ফ্ল্যাট বা আবাসনে) ফিরেছিলেন বাবা-মা। তার মধ্যেই সব শেষ! ভিন রাজ্যে ‘রহস্যমৃত্যু’ জেলা শহর মেদিনীপুরের মেধাবী ছাত্রের! নিজেদের একমাত্র ছেলের মর্মান্তিক পরিণতিতে শোকে পাথর হয়ে গেলেও, যথাযথ তদন্ত চাইছেন চিকিৎসক বাবা এবং মা। জানা যায়, মেদিনীপুর হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক তথা অধ্যাপক সুদীপ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে সৌরদীপ ঐতিহাসিক মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে এই বছরই (২০২৩) উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। তারপর, অন্ধ্রপ্রদেশের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (কে.এল বিশ্ববিদ্যালয়ে) কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং (বি.টেক) নিয়ে ভর্তি হয়েছিল সৌরদীপ। চলতি সপ্তাহের সোমবার (২৪ জুলাই) তার ‘রহস্যমৃত্যু’ হয় অন্ধপ্রদেশের গুন্টুর (Guntur) জেলার বিজয়ওয়াড়া (Vijayawada)-তে অবস্থিত সেই কে.এল বিশ্ববিদ্যালয় (K L Deemed To Be University) ক্যাম্পাসেই। ১৩ তলা হোস্টেলের ১১ তলা থেকে পড়ে গিয়ে (আত্মহত্যা নাকি র‌্যাগিংয়ের শিকার?) তার মৃত্যু হয় বলে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পরিবারকে জানানো হয়।

thebengalpost.net
সৌরদীপ চৌধুরী (ছবি- পরিবার সূত্রে পাওয়া):

প্রসঙ্গত, অন্ধ্রপ্রদেশের সব থেকে নামকরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বি.টেক কোর্সে ভর্তি হয়েছিল (মাত্র কয়েকদিন আগেই) সৌরদীপ। মঙ্গলবার ছেলের মৃতদেহ নিয়ে ফিরে আসার পথে অ্যাম্বুলেন্সে বসেই ফোনে সৌরদীপের বাবা তথা মেদিনীপুর শহরের গোলকুঁয়াচকের (শুভম এপার্টমেন্ট) বাসিন্দা ও চিকিৎসক সুদীপ চৌধুরী জানান, “গত সপ্তাহের সোমবার (১৭ জুলাই) ছেলেকে হোস্টেলে রেখে, আমরা (ডঃ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী) বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) ওখান থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা শুক্রবার (২১ জুলাই) বিকেলে এখানে (মেদিনীপুরে) পৌঁছই। মাঝখানে শুধু শনিবার ও রবিবার। সোমবার বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে ওখান থেকে ফোন আসে! তেলেগু আর হিন্দিতে মেশানো কথায় যেটুকু বলা হয়, ‘আপনার ছেলে ওপর থেকে পড়ে গেছে, তাড়াতাড়ি আসুন!’ আমি বুঝে যাই খুব খারাপ কিছুই হয়েছে। আমার শ্যালককে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা রওনা দিই। তারপর রাতের ফ্লাইট ধরে বিজয়ওয়াড়াতে পৌঁছই।”

এরপরই, হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডঃ চৌধুরী ফোনে আমাদেরকে যা জানান, তাতে রীতিমতো শিহরিত হয়ে উঠতে হয়! তিনি বলেন, “আমি আর আমার স্ত্রী গত সোমবার (১৭ জুলাই) ছেলেকে নিয়ে ওখানে পৌঁছই। মঙ্গলবার থেকে ও (সৌরদীপ) হোস্টেলে থাকে। আর, আমরা ওখানে একটি হোটেলে গিয়ে উঠি। আমরা বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। তারপর বেরিয়ে আসি। এর মধ্যেই কিছু ঘটনা ঘটে যায়।” ডঃ চৌধুরী বলেন, “আমার ছেলেকে হোস্টেলের যে রুম (সিঙ্গেল ডিলাক্স রুম) দেওয়ার কথা ছিল (এবং সেজন্য আমার কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের টাকাও নেওয়া হয়েছিল); বাস্তবে তা দেওয়া হয় না। একটি ছোটো রুমে রাখা হয়। বুধবার আমি এর প্রতিবাদ করায়, অন্য একটি নির্মীয়মান ১৩ তলা হোস্টেলের ১১ তলার একটি রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই রুমে ৩টে বেড ছিল। ওই বিষয়টা নিয়েই ছেলে মনে মনে একটু ক্ষুন্ন ছিল। ও বারবার আমাকে ফোনে বলছিল, তোমার এতগুলো টাকা শুধু শুধু নষ্ট! একইসঙ্গে ওখানে ভাষা নিয়ে একটা সমস্যা ছিল। তেলেগুভাষীদেরই দাপট ওখানে! মেদিনীপুরের আরও ৫ জন ওখানে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু, তাদের সঙ্গে ওকে রাখা হয়নি। ও সারাদিন হিন্দিভাষী কয়েকজনের রুমেই কাটাতো। তবে, রবিবার দুপুর (২৩ জুলাই) পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। রবিবার সন্ধ্যায় ও আমাদের ফোন ধরে না। রাত্রি ১১টায় অবশ্য একটু কথা হয়। আমরা বলি, ঘুমিয়ে পড়তে; সোমবার সকালেই ক্লাস আছে। সোমবার সকাল ৬টায় ছেলেকে গুড মর্নিং বলি। বললো ক্লাসে যাবে। এরপর, দুপুর ১টা ৪০ নাগাদ ওকে হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চাই, একটা টাকা পাঠিয়েছি, ঢুকেছে কিনা। এরপর, আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। সোমবার বিকেল ৩টা ৪৫ নাগাদ ফোনটা আসে!” ডঃ চৌধুরীর সংযোজন, “মেদিনীপুর থেকে রওনা দেওয়ার পথে আমি হোয়াটসঅ্যাপ খুলে ওর মেসেজগুলো দেখি। দেখি, ৩টা ১০ এ লিখেছে টাকা ঢোকনি। ৩টা ২৭ এ বন্ধুদের উদ্দেশ্যে স্ট্যাটাস দিয়েছে, তোদের অনেক জ্বালালাম, ভালো থাকিস! ৩টা ৪১ মিনিটে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছে, তোমরা ভাল থেকো! তারপর, ৩টা ৪৫ নাগাদ ওখান থেকে ফোনটা আসে। আমি আমার শ্যালককে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিই।”

thebengalpost.net
গুগল থেকে প্রাপ্ত কে.এল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি:

বিজয়ওয়াড়াতে পৌঁছেই একের পর এক রহস্যজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় বলে জানান চিকিৎসক সুদীপ চৌধুরী। তিনি বলেন, “আমাদের জন্য বিমানবন্দরেই গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর, আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় মনিপাল হাসপাতালে। ওখানেই দেহ রাখা ছিল। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার বলেন, আপনারা দেহ নিয়ে যেতে পারেন, ময়নাতদন্তের প্রয়োজন নেই। আমি এতে অবাক হই! আমি বলি, না, ময়নাতদন্ত হবে। আমি এফআইআর (FIR) দায়েরও করব। এরপর ওরা রাজি হয়। ময়নাতদন্তের জন্য দেহ নিয়ে যাওয়া হয় কিছুটা দূরে পুলিশ হাসপাতালের মর্গে। ওখানেই পুলিশের কাছে জানতে পারি, দেহ পুলিশ নিয়ে আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফেই মনিপাল হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন স্টাফ এবং ওই হোস্টেল নির্মাণের দায়িত্বে থাকা বাঙালি (কলকাতার বাসিন্দা) প্রোমোটার আমাদের সঙ্গে ছিল। মৃত্যুর বিষয়ে ওদের জিজ্ঞেস করলে বলেন, ১১ তলা থেকে পড়ে গিয়ে হয়েছে! ওঁরা এও বলেন, উপুড় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু, প্রথমবার আমার ছেলের মৃতদেহ দেখেই আমার সন্দেহ হয়। দেখি একটা নতুন জামা এবং নতুন জিন্সের প্যান্ট পরে আছে। শরীরে কোথাও কোন দাগ বা কাদা নেই। শুধু মাথার পেছনটা রক্তে ভেসে গিয়েছিল বোঝা যাচ্ছে। আর, মুখের একটা পাশে (গালে) আঘাতের দাগ! নাক আর কান দিয়েও রক্তপাত হয়েছিল মনে হচ্ছে। একটা হাতও ভেঙে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। তবে, শরীরের আর কোথাও কোনও দাগ নেই। উপুড় হয়ে পড়লে যেমনটা হওয়ার কথা, তেমন একবারেই নয়। সবথেকে, আশ্চর্যের হল, ওর হাতে একটা তামার (কপারের) বালা ছিল; সেটা নেই! এই হচ্ছে পরিস্থিতি। আমি নিজে একজন চিকিৎসক। তাই বুঝতে পারছি, এটা আত্মহত্যা হতে পারে না! দেখা যাক। পুলিশ এফআইআর নিয়েছে। আমাকে কপিও দিয়েছে।” এদিকে, শহর মেদিনীপুরের এই মেধাবী ও হাসিখুশি ছাত্রের মৃত্যুর খবর আসার পরই, মঙ্গলবার সকাল থেকে সৌরদীপের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-পরিজনেরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা! আজ (বুধবার), বেলা ১টা-২টো নাগাদ সৌরদীপের দেহ মেদিনীপুর শহরে (গোলকুঁয়াচকের আবাসনে) পৌঁছেতে পারে বলে অনুমান।