দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৬ জানুয়ারি: পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা পুলিশ সুপার (SP/ Superintendent of Police) এর বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের। বৃহস্পতিবার এক নির্যাতিতা (গণ-ধর্ষণের শিকার) গৃহবধূর মামলায়, পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি’কে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়ার সাথে সাথেই, তাঁর বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ নিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি’র তলফে ‘সতর্ক’ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সেই ‘সতর্ক’ করে দেওয়ার কথা তাঁর (এসপি’র) সার্ভিস বুকে লিখে দিতে হবে (shall stand converted to a warning and shall be entered into service records of the S.P) বলে কার্যত নজিরবিহীন নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গণধর্ষণের শিকার হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের আনন্দপুর থানার বাসিন্দা এক গৃহবধূ তাঁর স্বামীকে নিয়ে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে, ফিরিয়ে দেন পুলিশ আধিকারিকরা। এমনকি, মেদিনীপুর জেলা আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর-ও হেলদোল দেখা যায়নি। জেলা পুলিশ সুপার বা SP’র দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি! গত আগস্ট (১১ আগস্ট, ২০২২) মাসের সেই ঘটনায় শেষমেশ কলকাতা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিলেন নির্যাতিতা গৃহবধূ। যথাক্রমে গত ৮ সেপ্টেম্বর ও ১৬ নভেম্বর (২০২২) ওই মামলার শুনানি শেষে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা আনন্দপুর থানার তৎকালীন ওসি (সুবীর মাজি) এবং জেলা পুলিশ সুপার (দীনেশ কুমার)- এর বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে তদন্ত করে রিপোর্ট পেশ করার নির্দেশ জারি করেছিলেন। ইতিমধ্যে জেলা পুলিশের তরফে অভিযুক্ত ওসি-কে ক্লোজ করা হয়েছে। এদিকে, গত ২ ডিসেম্বর (২০২২) জেলা পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে তদন্ত করে রাজ্য পুলিশের ডিজি আদালতে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারকে এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল ও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।” এরপরই, গতকাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা SP’র বিরুদ্ধে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন।
সেই সঙ্গে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সুপারের চরম উদাসীনতার কথা উল্লেখ করে, রাজ্যের সব জেলার পুলিশ সুপারদের বিরুদ্ধেও কড়া নির্দেশ দিল হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার ওই মামলার শুনানিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এখন থেকে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ এলে কোনওরকম দেরি না করে দ্রুত এফআইআর করে তদন্ত শুরু করতে হবে। যদি সে ক্ষেত্রে কোনও গাফিলতি হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ জেলা পুলিশ সুপার বা বিভাগীয় কমিশনারদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করতে হবে রাজ্যকে। এমনই নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা। রাজ্য পুলিশ তথা ডিজি’র উদ্দেশ্যে বিচারপতির আরও নির্দেশ, আদালতের এই নির্দেশের কথা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বা নির্দেশ জারি করে সব জেলার পুলিশ সুপারদের জানাতে হবে ডিজিকে। সেই নির্দেশ নিজেরা পড়ে তাতে স্বাক্ষর করে সেটি ডিজির কাছে পাঠাবেন পুলিশ সুপাররা। একই সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি। অন্যদিকে, সিআইডি-কে এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ঘটনাক্রমে জানা যায়, আনন্দপুর থানার বাসিন্দা এক যুবক আলু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় চন্দ্রকোণা রোডেও একটি বাড়ি তৈরি করেন। বিয়ের পর স্ত্রী-কে নিয়ে দু’জায়গাতেই থাকতেন। হঠাৎ গত ২১ এপ্রিল (২০২২) টাকা-পয়সার দাবি করে চন্দ্রকোণা রোড এলাকার তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁদের মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং চন্দ্রকোণা রোডের ওই বাড়ি দখল করে। যুবকের অভিযোগ অনুযায়ী, এই বিষয়ে চন্দ্রকোণা রোড পুলিশ ফাঁড়ি তাঁদের অভিযোগ না নেওয়ায় গড়বেতা থানায় লিখিত অভিযোগ (জিডি) করেন তিনি। তারপর মেদিনীপুর আদালতের শরণাপন্ন হলে কোর্ট বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয় প্রভাবশালী ওই তিনজনকে। কিন্তু, সেই নির্দেশ তারা উপেক্ষা করে। এমনকি, ১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও, বেআইনিভাবে ওই বাড়িতে নির্মাণ কার্য-ও চালিয়ে যায়। এরপর, জেলা পুলিশ সুপারের দপ্তর থেকে বিডিও, বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জানান অত্যাচারিত যুবক। এরপরই, তাঁর সাথে এবং তাঁর স্ত্রী’র সাথে ঘটে যায় হাড় হিম করা ঘটনা! যুবকের বর্ণনা অনুযায়ী, “চন্দ্রকোণা রোডের ওই তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি একদিন ফোন করে আমাকে বলেন, যা হয়েছে হয়েছে, একদিন রোডে তোমার বাড়িতে এসো, সব মিটিয়ে নেব। এরপর, আমি আর আমার স্ত্রী গত ১১ আগস্ট (২০২৩) চন্দ্রকোণা রোডের বাড়িতে যাই। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর, আমি বলি ঠিক আছে, আমি হোটেলে থেকে খেয়ে আসি, ফিরে এসে বাকি কথা হবে। ওরাও বলে ঠিক আছে। ওরা চলে যাওয়ার পর, আমি স্ত্রী-কে আমাদের বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে খেতে যাই। ওর (স্ত্রী’র) জন্য খাওয়ার নিয়ে আসার কথা বলে, ওকে দরজা লাগিয়ে দিতে বলি এবং আমি বাইরে বেরিয়ে যাই। তার মধ্যেই ওরা তিনজন ফিরে এসে, আমার স্ত্রী-কে ধর্ষণ করে! আমি যখন খাওয়ার নিয়ে পৌঁছই তখন পালিয়ে যায়। এরপর, পরিস্থিতি কিছুটা সামলে, আমরা ভয়-আতঙ্ক সঙ্গে নিয়েই যখন চন্দ্রকোণা রোড পুলিশ ফাঁড়ির দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই; ওরা ফিরে এসে আমার গলায় ছুরি বসিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যায়। এরপরই আমরা ওখান থেকে পালিয়ে যাই আনন্দপুরের উদ্দেশ্যে। শালবনী পেরোনোর পর, ফের জঙ্গলরাস্তায় আমাদের পথ আটকে মারধর করা হয় এবং হুমকি দেওয়া হয়। সেই অবস্থাতেই আমরা ওইদিন আনন্দপুর থানায় যাই। কিন্তু, সব শুনে পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে এবং বলে চন্দ্রকোনা রোড বা গড়বেতা থানায় ওই অভিযোগ জানাতে অথবা কোর্টে অভিযোগ জানাতে!” এরপরই, তাঁরা প্রথমে (১৬ আগস্ট) মেদিনীপুর জেলা আদালত ও পরে (সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে) কলকাতা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।