দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ১৯ অক্টোবর: জ্বলছে রংপুর, নোয়াখালি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম! চলছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর অত্যাচার। ভাঙচুর করা হচ্ছে মন্দির, দেব-দেবীদের মূর্তি। হত্যা করা হয়েছে ইসকনের ভক্ত যুবক প্রান্তচন্দ্র দাস (২৬)-কে। নিখোঁজ আরও একাধিক। সাম্প্রদায়িক বর্বরতায় উত্তাল সারা বিশ্ব! রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিউ ইয়র্কের সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সেদেশের ইসকনের সদস্যরা। সারা বাংলাদেশের হিন্দু এবং সম্প্রীতি-প্রেমী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাজপথে বিশাল মিছিল করেছেন। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ (মুজিবর রহমান)’র দেশের শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ। অভিনেত্রী জয়া আহসান তাঁর অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে রংপুরের জ্বলন্ত ছবি দিয়ে লিখলেন- “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না/এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না”। সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনগুলোই এই অশান্ত সময়ে স্মরণ করেছেন জয়া। অন্যদিকে, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গর্জে উঠেছেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশে হিন্দু-নিধন কোনও নতুন ঘটনা নয়! এর আগেও হয়েছে। তিনি এর প্রতিবাদেই লিখেছিলেন- ‘লজ্জা’। যা শুধু বাংলাদেশ নয়, এপার বাংলাতেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু-কন্যা তথা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-র কড়া সমালোচনা করেছেন তসলিমা। তসলিমা নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কাল (শনিবার) রাতে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন যখন রংপুরের পীরগঞ্জে দুটো হিন্দু গ্রাম পুড়ছিল! আজ (রবিবার) সকাল থেকেই তিনি তাঁর ছোট ভাই শেখ রাসেলের জন্ম বার্ষিকী খুব ঘটা করে পালন করছেন। আজকের দিনটি তো আবার যে সে দিন নয়, রীতিমত ‘শেখ রাসেল ডে’। সারা দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে এই ‘ডে’। হিন্দুরা গৃহহীন পড়ে আছে, বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে, পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শেখ রাসেলের বয়সী কত কত বালক আজ ধংসস্তূপের সামনে বসে অনাহারে কাটাবে, বংশীবাদকের কি সময় হবে তার খোঁজ নেওয়ার?” অন্যদিকে, তসলিমা একহাত নিয়েছেন ভারতের বামপন্থীদেরও! যারা ১৯৯৩ সালে তাঁকে ‘গালাগাল’ দিয়েছিলেন, তাঁর ‘লজ্জা’ বইতে ‘অসাম্প্রদায়িক’ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক চিত্র তুলে ধরেছিলেন বলে!
এদিকে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে হামলা চালানো হয়েছে এবং এই হামলা ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলে রবিবার দাবি করেছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বুধবার কুমিল্লায় দুর্গাপুজোয় হামলার ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়েরের পর রবিবার এই মন্তব্য করেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ”পবিত্র কোরানের মানহানি করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে কুমিল্লায় হিন্দুদের উপর হামলা পূর্বপরিকল্পিত ছিল। এর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা।” তিনি আরও বলেন, ”আমাদের কাছে মনে হয় যে এটি কোনও বিশেষ গোষ্ঠী দ্বারা প্ররোচিত।” এরপরই, সোমবার হিংসা বিধ্বস্ত বাংলাদেশে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে বড়সড় পদক্ষেপ করল বাংলাদেশ সরকার। সরিয়ে দেওয়া হল বাংলাদেশের হিংসা ধ্বস্ত জেলাগুলির পুলিস প্রধানদের। সোমবার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এক নির্দেশিকা জারি করে একথা জানিয়েছে। বদলি করা হয়েছে ফেনি, রাংপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিস প্রধানকে।
অপরদিকে, সোমবার কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, “গোটা বিশ্বে হিন্দু বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। সেই উৎসবের দিন থেকে লাগাতার বাংলাদেশের সনাতনী বাঙালি হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চলছে, অসংখ্য পুজো মন্ডপের মা দুর্গার মূর্তি, মন্দির সহ ইসকন এ পর্যন্ত হামলা হয়েছে। উগ্র মৌলবাদীদের নেতৃত্বে পাশবিক এই আক্রমণে ইসকনের একজন ভক্ত সহ কয়েকজন বাঙালি হিন্দু মারা গিয়েছেন, আহত শতাধিক! বয়স নির্বিশেষে হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছে, হিন্দু গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে । এই অরাজকতার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বাঙালি সনাতন হিন্দুদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় জনতা পার্টির বিধায়কদের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে নিয়ে কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের বার্তা সঠিক জায়গায় পৌঁছবে।” এদিকে, নীরবতা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ-বার্তা জারি করেছেন এপার বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও। পবিত্র সরকার, কৌশিক সেন, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, চন্দন সেন সহ বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে দুষ্কৃতীদের ‘উপদ্রব’ বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’র কাছে আবেদন জানিয়েছেন। যদিও, এতবড় এক সাম্প্রদায়িক বীভৎসতা এবং নারকীয় তান্ডবলীলা-কে সামান্য ‘উপদ্রব’ হিসেবে চিহ্নিত করায়, তাঁদের সমালোচনা করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে! তবে, তার থেকেও আশ্চর্য ঘটনা যে, এখনও পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ‘মৌনতা’ বজায় রেখে চলেছেন, যাঁরা আবার দেশের বা বিদেশের কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনায় হাতে মোমবাতি নিয়ে মিছিলে হাঁটতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা দেরি করেননা!