মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৪ জুলাই: UGC (University Grants Commission)’র ২০২৩-র গাইডলাইন আনুযায়ী, পড়ুয়াদের যে কোনও ধরনের অভিযোগ বা সমস্যার সমাধানের জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে Ombudsperson (s) বা ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করতে হবে। তাঁর নেতৃত্বে (চেয়ারপার্সন) গঠিত কমিটিই পড়ুয়াদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করবেন। গাইডলাইন অনুযায়ী, ‘ন্যায়পাল’ (Ombudsperson)-কে হতে হবে যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপাচার্য অথবা কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধ্যাপক বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক (District Judge)। নিয়ম মেনেই জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় (Vidyasagar University) ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Kalyani) প্রাণীবিদ্যা (Zoology) বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ‘প্রফেসর’ অনিলাভ কবিরাজ (Prof. Anilava Kaviraj)-কে ‘ন্যায়পাল’ বা Ombudsperson হিসেবে নিয়োগ করে। এরপর, UGC-র নির্দেশ মত নির্দিষ্ট ফরম্যাটে ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যও জমা করা হয়। তা সত্ত্বেও, গত ১৯ জুন (২০২৪) UGC-র তরফে যে ‘ডিফল্টার লিস্ট’ বা ‘খেলাপি তালিকা’ (Defaulter List) বের করা হয়, সেই তালিকায় জ্বলজ্বল করে জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের ‘গর্বের’ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় (Vidyasagar University)-র নাম! অর্থাৎ, ইউজিসি-র নির্দেশিকা মেনে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় ‘ন্যায়পাল’ (Ombudsperson) নিয়োগ করেনি!

thebengalpost.net
বুধবারের সাংবাদিক বৈঠকে উপাচার্য, নিবন্ধক সহ আধিকারিকরা (নিজস্ব চিত্র):

জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ব মেদিনীপুরের মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের ১০৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমেত মোট ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয়-কে ‘ডিফল্টার’ বা ‘খেলাপি’ চিহ্নিত করে গত ১৯ জুন (২০২৪) নিজেদের ওয়েবসাইটে তালিকা (List of Defaulters) প্রকাশ করে UGC। শুধু তাই নয়, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এই সংক্রান্ত চিঠিও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২২ জুন (২০২৪) সেই চিঠি হাতে পেয়ে ‘চক্ষু চড়ক গাছ’ হয়ে যায় মেদিনীপুর শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (Vice Chancellor), নিবন্ধক (Registrar), ছাত্র কল্যাণ আধিকারিক (Dean of Students Welfare/DSW) সহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই! এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চিঠি পৌঁছনোর আগেই সর্বভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ‘লজ্জার’ এই খবর প্রকাশিত হয়ে যায়। নেট-নিট দুর্নীতির মধ্যেই এই ঘটনাতেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় দেশের ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। কার্যত কোনও ‘দোষ’ না করেও ‘শাস্তি’ হয়ে যায় বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের! কারণ, গত ২ জুলাই (মঙ্গলবার) ইউজিসি (UGC) পুনরায় (Updated) যে ‘ডিফল্টার লিস্ট’ (খেলাপি তালিকা) প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় ৪৬-টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ নাম রয়েছে মাত্র ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের! বাদ গেছে বিদ্যাসাগর (Vidyasagar University), কল্যাণী (University of Kalyani) সহ দেশের ৯৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। অর্থাৎ, ১৫৭ নয, সংশোধিত তালিকা (Updated or Corrected List) অনুযায়ী দেশের ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি-র নিয়ম মেনে ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করেনি। প্রথম তালিকায় (১৯ জুনের লিস্টে) যেখানে পশ্চিমবঙ্গের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল, সংশোধিত তালিকায় তা কমে হয় ছয় (৬)। ২ জুলাইয়ের তালিকা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয় (Alipurduar University), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Calcutta), দক্ষিণ দিনাজপুর বিশ্ববিদ্যালয় (Dakshin Dinajpur University), দার্জিলিং হিলস ইউনিভার্সিটি (Darjeeling Hills University), পূর্ব মেদিনীপুরের মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয় (Mahatma Gandhi University) এবং শিবপুরের বেসু (The Bengal Engineering and Science University) ইউজিসি-র নিয়ম মেনে ন্যায়পাল বা Ombudsperson নিয়োগ করেনি।

বুধবার (৩ জুলাই) বিকেলে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (Vidyasagar University) পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত একটি সাংবাদিক বৈঠক (Press Meet) করে উপাচার্য (Vice Chancellor) অধ্যাপক সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী বলেন, “গত ২৯ আগস্ট (২০২৩) আমরা ন্যায়পাল বা Ombudsperson নিয়োগ করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ন্যায়পাল’ হিসেবে অধ্যাপক অনিলাভ কবিরাজ ইউজিসি-র একটি অনলাইন মিটিংয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি (২০২৪) অংশও নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও জানিনা কিভাবে, UGC এত বড় ভুল করে ফেললো! ২২ জুন (২০২৪) হাতে চিঠি পাওয়ার পরই আমরা ২৪ জুন প্রত্যুত্তর (রিপ্লাই) পাঠাই। পুরো বিষয়টিই তুলে ধরা হয়। এছাড়াও, গত ২৮ জুন (২০২৪) গুয়াহাটির একটি মিটিংয়ে আমার সঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যানের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়। তাঁকে জানাই, ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় রীতিমত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারপরও, ডিফল্টার লিস্টে কি করে বিদ্যাসাগরের নাম আসে! উনি অবশ্য জানান, এরকম আরও বেশ কয়েকটি অভিযোগ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। দ্রুত নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে। তারপরই ২ জুলাই ‘সংশোধিত’ (বা, Updated) তালিকা প্রকাশিত হয়। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমরা প্রত্যন্ত জঙ্গলমহলের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েও যেভাবে কঠোর সংগ্রাম এবং ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে সমস্ত দায়িত্ব পালন করে এগিয়ে চলেছি; সেখানে কোনও ‘দোষ’ না করেও আমাদেরকেও সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ‘খেলাপি’ (Defaulter) তালিকায় রাখা হল। যা অত্যন্ত বেদনার!” এদিনের সাংবাদিক বৈঠকে উপাচার্য ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রেজিস্ট্রার (Registrar/নিবন্ধক) ড. জয়ন্ত কিশোর নন্দী, ছাত্র কল্যাণ আধিকারিক (DSW) ড. অশোক কুমার, স্পেশাল অফিসার ড. সৌদীপ কুমার সাউ। রেজিস্ট্রার ড. নন্দী বলেন, “ইউজিসি-র প্রতিটি গাইডলাইন আমরা সঠিকভাবে মেনে চলি। প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে থেকেও আমরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, গবেষণা, প্রকাশনা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমশ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে চলেছি সারা দেশ ও বিশ্বের দরবারে। স্বাভাবিকভাবেই তাই ইউজিসি-র ‘ভুলে’ সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সারা দেশের শিক্ষামহল হয়তো আমাদেরই ‘ভুল’ বুঝেছেন! এটাই আমাদের ব্যথিত করেছে।”

thebengalpost.net
১৯ জুনের লিস্টে পশ্চিমবঙ্গের ‘ডিফল্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম:

thebengalpost.net
২ জুলাইয়ের লিস্টে পশ্চিমবঙ্গের ‘ডিফল্টার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম: