তনুপ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১১ জানুয়ারি:একেই বোধহয় বলে অভাবে নয়, ‘স্বভাবে’ চুরি! বাবা পূর্ত দপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী৷ মা ছিলেন স্টিল অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া’র পদস্থ আধিকারিক। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আসানসোলে সুখের সংসার! ছেলে সৌমাল্য ইংরেজিতে MA পাস করার পর, গত ২০১৯ সালে দক্ষিণ পূর্ব রেলের খড়্গপুর শাখায় একটি চাকরিও জুটে যায়। কিন্তু, চাকরিতে তার মন ছিলনা! ছোটো থেকেই চুরির প্রতি টান। একাধিকবার মায়ের গয়না চুরি করেছে বলে নিজেই স্বীকার করেছে সৌমাল্য। তবে, সখের এই চৌর্যবৃত্তিকেই ‘পেশা’ করতে, আসানসোলে নিজেদের ফ্ল্যাটের উল্টোদিকে এক ফুলের কারিগরের কাছে চুরির প্রশিক্ষণ নেয় সৌমাল্য। এরপর, আসানসোলেই একটি বড়সড় চুরির ঘটনায় ধরা পড়ে চাকরি চলে যায় সৌমাল্য’র! তাতে তার আফসোস নয়, বরং মনের সাধই যেন পূরণ হয়। জামিনে ছাড়া পেয়ে শুরু করে একের পর এক চুরি! ২০২১ সালে হাওড়া’র আন্দুলের একটি ফ্ল্যাটে ১১ লক্ষ টাকা চুরির কেসে ধরা পড়ে চোর হিসেবে ‘বিখ্যাত’ (আদতে ‘কুখ্যাত’) হয় বছর ৩৫ এর সৌমাল্য চৌধুরী। সেই সৌমাল্য-ই এবার পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের বিদ্যুৎ দপ্তরের মহিলা কর্মী মহাশ্বেতা দে’র কোন্নগরের (১৬ নং ওয়ার্ড) ফ্ল্যাট থেকে ৩ লক্ষ টাকার গয়না চুরির কেসে পূর্ব মেদিনীপুরের মেছগ্রাম থেকে ধরা পড়ল! ঘাটাল থানার পুলিশ ৯ জানুয়ারি (রবিবার) সৌমাল্য-কে গ্রেফতার করে ঘাটালে নিয়ে আসে। সোমবার তাকে আদালতে তোলা হলে ৫ দিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেন বিচারক। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু, জিজ্ঞাসাবাদ করতে নেমেই পুলিশ অফিসারদের রীতিমতো ‘চক্ষু চড়কগাছ’! ঘাটাল পুলিশ সৌমাল্য’র শিক্ষাগত যোগ্যতা, পারিবারিক বিবরণ আর তার ‘অদ্ভুত’ শখের কথা শুনে অবাক! তাঁরা এও জানতে পারেন, ছেলের এই ‘কীর্তি’তে লজ্জিত হয়ে তার মা কয়েকমাস আগেই আত্মহত্যা করেন। তাতেও সৌমাল্য দমে যায়নি! পুলিশকে নিজের মুখেই জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১৭০ টি চুরি করেছে সে।

thebengalpost.net
সৌমাল্য চৌধুরী :

এ প্রসঙ্গে ঘাটালের মহকুমা পুলিশ আধিকারিক (SDPO) অগ্নিশ্বর চৌধুরী বলেন, “এমন অদ্ভুত শখ বা পেশা বেছে নেওয়া দেখে আমি তো অবাক! ইংরেজিতে মাস্টার ডিগ্রি করেছেন উনি। গত বছর হাওড়ায় এক চুরির ঘটনায় ধরা পড়ার পর তাঁর চাকরি চলে যায়। ভদ্র পরিবারের ছেলে। ছেলে চোর হয়েছে জেনে মা আত্মহত্যা করেছেন। আপাতত ধৃতকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ৩ জানুয়ারি দিনেদুপুরে বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্মী মহাশ্বেতা দে’র ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাট বাড়ির একাধিক তালা ভেঙে লক্ষাধিক টাকার (৩ লক্ষ আনুমানিক) সোনার গয়না চুরি হয়েছিল। চুরির অভিযোগ দায়ের করা হয় ঘাটাল থানায়৷ সিসিটিভি ক্যামেরার ছবি দেখে চুরির তদন্ত শুরু করে ঘাটাল থানার পুলিশ। ক্যামেরার ফুটেজ দেখা যায়, একটি নম্বর প্লেট হীন বাইকে করে এসে এক যুবক চুরি করছে! পুলিশ তদন্ত শুরু করে। রবিবার পূর্ব মেদিনীপুর পাঁশকুড়া সংলগ্ন মেছগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় সৌমাল্যকে। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত চোরের নাম সৌমাল্য চৌধুরী৷ সে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে MA পাস করেছে। দক্ষিণ পূর্ব রেলের খড়্গপুর শাখায় একটি চাকরিও করত। জেরায় সৌমাল্য জানিয়েছে, আগে তারা থাকত আসানসোলে। সেখান থেকেই তার বাবা বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে রেলের অস্থায়ী কর্মী হিসেবে তার কাজের জোগাড় করে দেন। কিন্তু, সেই কাজ নাকি তার ভাল লাগছিলো না। আসানসোলে থাকতে থাকতে স্থানীয় কয়েকজন দুষ্কৃতীর সঙ্গে মিশে চুরিতে হাত পাকায় সৌমাল্য৷ চুরি বিদ্যায় নিজের দক্ষতার কথা বোঝাতে গিয়ে সৌমাল্য নিজেই পুলিশকর্মীদের জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত সে ১৭০টি চুরি করেছে। এমন কি, কয়েক মাস আগে হাওড়া আন্দুলের একটি ফ্ল্যাট থেকে ১১ লক্ষ টাকা সোনার গহনা চুরি করায় সৌমাল্যকে পাঁশকুড়া থেকে গ্রেপ্তার করে সাঁকরাইল থানার পুলিশ। জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের চুরি চালিয়ে গেছে সৌমাল্য! এবার, ঘাটালের কোন্নগরের ওই চুরির ঘটনায় ঘাটাল পুলিশের হাতে ধরা পড়ল ‘বিদ্বান’ ও ‘সৌম্যসুন্দর’ এই অদ্ভুত চোর, সৌমাল্য। পুলিশকে নিজেই সৌমাল্য জানিয়েছে, একধরনের মানসিক সমস্যা (Mental Disorder) বা রোগ Clyptomania (চুরির বাতিক)-তে আক্রান্ত সে। এজন্য, মনোরোগ বিশেষজ্ঞকেও দেখিয়েছে সে। তবে, তিনি নাকি বলছেন, এই রোগে আক্রান্ত হলে, চুরির প্রবণতা বাড়বে বই কমবেনা! আপাতত পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। তবে, এই ধরনের চোরকে ঘিরে জেলাজুড়ে জল্পনার অন্ত নেই! অন্যদিকে, ভবিষ্যতে সৌমাল্য কোন পথে হাঁটে সেটাও এখন লাখ টাকার প্রশ্ন!

thebengalpost.net
বিদ্যুৎ কর্মীর এই বাড়িতেই চুরি হয়েছিল :