দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, কলকাতা ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৭ মে:মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে কলকাতার দুই উঠতি মডেলের আত্মহত্যা! সম্পর্কের টানাপোড়েন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, পেশাগত অনিশ্চয়তা, ইঁদুর দৌড় আর তা থেকে মানসিক অবসাদ। শেষমেশ, জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো ধ্বংসাত্মক ভাবনা! পল্লবী দে’র পর বিদিশা দে মজুমদার। আর, বিদিশা মৃত্যুরহস্যে-ই এবার মেদিনীপুর-যোগ! মেদিনীপুর শহরের যুবক অনুভব বেরা’র সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ই এখন জোর আলোচনায় কিংবা আতস কাঁচের তলায়। জানা যায়, মাত্র চার মাস আগে কলকাতার বিদিশা’র সঙ্গে ফেসবুক মারফত পরিচয় মেদিনীপুর শহরের অনুভবের। আর, এর মধ্যেই বিদিশার ‘বিশেষ বন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শহর মেদিনীপুরের তাঁতিগেড়িয়ার সুদর্শন যুবক অনুভব বেরা। বছর ২৬ এর অনুভবেরও নেশা ছিল মডেলিং। মডেলিং এবং অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই- এই দুই সূত্রেই দুই তরুণ-তরুণীর মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। ‘অনুভূতি’ ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়েই মেদিনীপুরের অনুভব ক্রমেই বছর ২১ এর বিদিশার মনে জায়গা করে নেয়। সেখান থেকেই মাত্র চার মাসেই ‘বিশেষ’ বন্ধু হয়ে ওঠা। বিদিশার বন্ধুবান্ধব থেকে তাঁদের সঙ্গে হওয়া বিদিশার চ্যাট (কথোপকথন)- এসব কিছুকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। সবটা অস্বীকার না করলেও, মেদিনীপুরের অনুভবের অনুভূতিতে অবশ্য, বিদিশা তাকে একতরফা ভালোবেসে ফেলেছিল! প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে, সে কখনও ‘আই লাভ ইউ’ বলেনি! চেয়েছিল, বন্ধু হয়েই থাকতে। যদিও, ‘বিশেষ সম্পর্ক’ গড়ে ওঠা নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে রাজি নয় শহরের তাঁতিগেড়িয়ার বাসিন্দা অনুভব। এদিকে, অন্যান্য নানা কারণের সাথে সাথেই সম্পর্কের এই ‘টানাপোড়েন’ বিদিশা মৃত্যুরহস্যে-র অন্যতম রসদ বা সূত্র বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। কারণ, মৃত্যুর মাত্র কয়েকঘন্টা আগে, বিদিশা তাঁর এক বান্ধবী-কে Whtsapp এ লিখে গেছেন, “আমি বাঁচতে পারবোনা অনুভবকে ছাড়া। আমি সত্যি চলে যাব সব ছেড়ে!”
প্রসঙ্গত, বুধবার (২৫ মে) বিকেলে নাগেরবাজারের (উঃ ২৪ পরগণা) রামগড় কলোনির বাড়ি থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় উঠতি মডেল হিসেবে পরিচিত বিদিশা দে মজুমদার (২১) এর ঝুলন্ত দেহ। টেলি অভিনেত্রী পল্লবীর দে’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় এই ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই শোরগোল ফেলে দেয়। সুইসাইড নোটে বিশেষ কাউকে দায়ী করা না হলেও, সম্পর্কের টানাপোড়েন, আশানুরূপ সাফল্য না আসা, শারীরিক অসুস্থতা- প্রভৃতি বিষয়গুলি উঠে এসেছে। যদিও, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী বিদিশা খুব লড়াকু মেয়ে ছিলেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত কেন? ময়নাতদন্তেও আত্মহত্যার বিষয়টি-তেই সিলমোহর দেওয়া হয়েছে। আর, এ ক্ষেত্রেই উঠে এসেছে, মৃত্যুর মাত্র কয়েকঘন্টা আগে, মঙ্গলবার গভীর রাতে বা বুধবার ভোররাতে বান্ধবী-কে লেখা নিজের মর্মবেদনার কথা। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দিয়া নামে এক বান্ধবীকে বিদিশা মঙ্গলবার রাত্রি ১ টা (ঘড়ির কাঁটায় বুধবার, ২৫ মে) নাগাদ হোয়াটসঅ্যাপে লেখে- “আমি বাঁচতে পারবোনা অনুভবকে ছাড়া। আমি সত্যি চলে যাব সব ছেড়ে! খুব ভালোবাসি ভাই। ও একটুও বোঝেনা। মিস করছি সবাইকে।” তার কয়েকঘন্টা পর বুধবার (২৫ মে) বিকেলে বিদিশা এই কান্ড ঘটায়! আদতে কাঁকিনাড়া’র বাসিন্দা বিদিশা কয়েক মাস আগেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নাগের বাজারে আসে বলে জানা গেছে। তাঁর মা সহ বাড়ির অন্যান্যরা শোকস্তব্ধ। তাঁরা জানিয়েছেন, বিদিশা সহজে লড়াই ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়! কি করে এমন হতে পারে! দু’দিন আগেই (রবিবার) বিদিশা বাড়ি গিয়েছিল। কাউকেই কিছু বুঝতে দেয়নি বলেও জানিয়েছেন তাঁর মা। অন্যদিকে, বিদিশার মেদিনীপুরের বন্ধু অনুভব বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে যা জানিয়েছেন, তা থেকে বিদিশার আঘাত পাওয়া (বা, আহত হওয়া) ও ভেঙে পড়ার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
অনুভব জানিয়েছে, বিদিশার সঙ্গে তার পরিচয় ২০২২-এর জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে। ফেসবুক মারফত আলাপ-পরিচয়-কথা বলা। তারপর, ঝাড়গ্রামে এসেছিল বিদিশা। সেখানে দেখা হয়। এদিকে, অনুভব কলকাতায় গিয়ে দেখা করার কথা না জানালেও, বিদিশার বান্ধবীর জানিয়েছেন, অনুভবের সঙ্গে বিদিশার একাধিকবার দেখা হয়েছে এবং সব ধরনের (শারীরিক সহ) সম্পর্ক ছিল। অনুভব শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও, জানিয়েছে যে, “ওকে আমি খুব সাপোর্ট করতাম, কেয়ার করতাম বলে ও আমাকে ভালোবাসে ফেলে এবং একদিন প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমি জানিয়েছিলাম, আমরা বন্ধু হিসেবেই ঠিক আছি। তবে, সবসময় পাশে থাকব।” ঠিক এই কথাই যেন বিদিশার শেষ হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে ফুটে উঠেছে, “খুব ভালোবাসি ভাই। ও একটুও বোঝেনা!” বিদিশার বান্ধবীরা জানিয়েছেন, “অনুভবদা-কে ও খুব ভালোবাসত। তবে, অনুভবদা’র আরও একাধিক সম্পর্ক ছিল। যেটা বিদিশা মেনে নিতে পারেনি!” অন্যদিকে, এর আগেও বিদিশার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, কেরিয়ারে নানা উত্থান-পতন, সঙ্গে সাম্প্রতিক শারীরিক অসুস্থতা- এই সমস্ত নানা কারণে ‘মানসিক অবসাদ’ ছিল বলে স্বীকার করছে সব মহলই। মেদিনীপুরের যুবক অনুভব জানিয়েছে, “যখন থেকে ওর সঙ্গে পরিচয়, তখন থেকেই ও ডিপ্রেশনে ছিল। এর আগেও দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল বলে বিদিশা নিজেই আমাকে জানিয়েছিল। ক্যারিয়ার নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিল। তবে, আমি সবসময় বোঝানোর চেষ্টা করে গেছি!” সবমিলিয়ে, অত্যাধুনিক জীবনযাত্রা, সম্পর্কের টানাপোড়েন আর কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়ার হতাশা- আরও একটি ফুল অকালে ঝরিয়ে দিল বলেই মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।