মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৬ জুলাই: “তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে চলেছে মানবযাত্রী/ যুগ হতে যুগান্তর পানে/ ঝড়ঝঞ্চা বজ্রপাতে/ জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে অন্তর প্রদীপখানি”। ‘বিশ্বকবি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্ববন্দিত কবিতা “এবার ফিরাও মোরে”র সেই বিখ্যাত লাইনগুলি যেন স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে! ‘কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য’ বা ‘হৃদয়ে লালন করা স্বপ্ন’ পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে মানুষ যদি ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রত থাকে, একদিন না একদিন স্বপ্ন পূরণ হবেই! মনে করেন পণ্ডিতেরা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত পিংলা গ্রামের প্রণতি নায়েকের (Pranati Nayek) রূপকথার এই “যাত্রা”ও এমনই এক স্বপ্নপূরণের কাহিনী। যেখানে শুধু স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা ছিলোনা; ছিলো আন্তরিক প্রচেষ্টা, অসহনীয় যন্ত্রণা, তীব্র লড়াইয়ের কঠোর-কঠিন বাস্তবতা! বৃহস্পতিবার অলিম্পিকের উদ্দেশ্যে জাপান রওনা দিয়েছে প্রণতি। শুক্রবার সকালে পিংলার কড়কাই (চক কৃষ্ণদাসপুর) গ্রামের বাড়িতে বসে বাবা শ্রীমন্ত নায়েক কিংবা ছোটোবেলার প্রশিক্ষক চন্দন কুমার পাঁজা যখন প্রণতি’র লড়াইয়ের সেই দিনগুলোর কথা তুলে ধরলেন, এক নিমেষে মনে হতে বাধ্য- “সত্যিই এক রূপকথার যাত্রা। যেকোনো দিন, যেকোনো সময়ে হয়তো এই যাত্রা থেমে যেতে পারতো”! চোখে জল নিয়ে, পিংলার তথা জেলার একসময়ের সুপরিচিত জিমন্যাস্টিক প্রশিক্ষক (অর্থের অভাবে, আজ শুধুই এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী) চন্দন কুমার পাঁজা বললেন, “প্রণতি শুধু ১৩০ কোটি ভারতবাসীর স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার নিয়েই অলিম্পিক যাত্রা করেনি; ওর প্রতিটা লড়াই, প্রতিটা স্টেপের সঙ্গে, প্রত্যন্ত বাংলা তথা জেলার না খেতে পাওয়া, অর্থের অভাবে স্বপ্ন ধংস হয়ে যাওয়া প্রতিটা মেয়ের চোখের জলও জড়িয়ে আছে। তাই ওর জয় শুধু বিস্ময় প্রতিভা প্রণতির জয় নয়, হবে লড়াইয়ের অপর নাম প্রণতির জয়!”
জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত পিংলা গ্রামের ২৬ বছরের (জ: ১৯৯৫ এর ৬ এপ্রিল) তরুণী প্রণতি ১৭ ই জুলাই অর্থাৎ আগামীকাল জাপানের টোকিওতে পৌঁছে যাবে। অলিম্পিক্সে দলগত (অল রাউন্ড) এবং ব্যক্তিগত বিভাগে নামবে প্রণতি। যে চারটি ইভেন্টে তাকে লড়াই করতে হবে, সেগুলি হল- ফ্লোর এক্সারসাইজ, আনইভেন বারস, ব্যালেন্স বিম এবং ভল্ট। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে এশিয়ান জিমনাস্টিক চাম্পিয়ানে ব্রোঞ্জ পদক জিতে জেলা, রাজ্য ও দেশকে গর্বিত করেছে প্রণতি। এবার, মহাদেশীয় কোটা বা কন্টিনেন্টাল কোটাতে প্রণতি অলিম্পিকের ছাড়পত্র পেয়েছে সে। কয়েকমাসের কঠোর অনুশীলনের পর গতকাল রওনা দিয়েছে প্রণতি। এদিকে, পিংলার কড়কাই গ্রামে তার বাবা-মা, ছোটোবেলার কোচ থেকে শুরু করে প্রত্যেক গ্রামবাসীই দিন-রাত জেগে প্রণতির সাফল্য কামনা করে চলেছেন। সঙ্গে অবিশ্বাস্য এক স্বপ্নপূরণের চৌকাঠে বসে চলছে, স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে প্রণতির ছোটোবেলার দিনগুলিকে মনে করার পালা! বাবা শ্রীমন্ত নায়েক দেখালেন, কিভাবে বাড়ির পাশেই গাছে গাছে দড়ি বেঁধে চলতো প্রণতি’র লাফ দেওয়ার প্রশিক্ষণ। ছোট্ট সেই মাঠ এখন আগাছায় ভরে গেলেও, গাছে বাঁধা দড়িগুলির অস্তিত্ব আছে। আছে ঘরের জানালায় বাঁধা দড়িগুলির চিহ্নও। বাবা দেখালেন কিভাবে সিঁড়ির ধাপে ধাপে দাঁড়িয়ে অথবা কাঠের টুলের উপর দাঁড়িয়ে তার শারীরিক কসরৎ চলতো। মা প্রতিমা নায়েক শোনালেন, “২ বছর থেকেই লাফ-ঝাঁপ মারতো। একটু বড় হয়েই পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া থেকে শুরু করে লং জাম্প, হাই জাম্প দিত। পড়াশোনার সাথে সাথে এইসবে ওর ছোটোবেলা থেকেই পটু ছিলো। স্কুল, পাড়ার ক্লাব বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সফল হতো। এইসব দেখে ওর সেজ মাসী ওকে জিমন্যাস্টিকে ভর্তি করে দেয়।”
বাবা শ্রীমন্ত নায়েক এরপর শোনালেন এক নির্মম স্বপ্নপূরণের কাহিনী, “স্কুল থেকে প্রথম হয়ে যখন জেলাতেও প্রথম হলো, তারপরই অনেকে বললো কলকাতায় ভর্তি করে দিতে। এরপর, রাজ্যেও ও সফল হলো। সল্টলেকের সাই কমপ্লেক্সে ভর্তির বা অনুশীলনের সুযোগ পেল। কিন্তু, কিভাবে সম্ভব হবে? পিংলা থেকে প্রতিদিন কিভাবে নিয়ে যাব কিংবা কলকাতায় রাখবোই বা কোথায়! এসব ভাবতে ১ সপ্তাহ সময় নিলাম। ওর কোচ মিনারা বেগম বললেন, আপনারা যদি এখানে নিয়ে আসতে পারেন, ওর সব দায়িত্ব আমার। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। না খেয়ে দেয়ে, আমরা ওকে সাই কমপ্লেক্সে ভর্তি করলাম। কোনও সপ্তাহে আমি, কোনও সপ্তাহে ওর মা গিয়ে সোম থেকে শুক্র বার পর্যন্ত থাকতাম। খুব কষ্ট হতো। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। অনেকেই সাহায্য করেছিলেন। ওর কোচ মিনারা বেগমের (Minara Begum) অবদান ভোলার নয়! শেষ পর্যন্ত চন্ডীগড়ের একটি প্রতিযোগিতায় রাজ্য থেকে অংশগ্রহণ করে প্রথম হওয়ার পর, ওর থাকা-খাওয়া সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো সাই কমপ্লেক্সের হোস্টেলে।” এভাবেই, প্রণতির দুর্বিষহ লড়াইয়ের যাত্রাপথ তৈরি হয়েছে। কিন্তু, অর্থের অভাবে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার কত শত ‘প্রণতি’! পিংলা গ্রামের চন্দন বাবু তথা প্রণতির ছোটোবেলার প্রশিক্ষক বললেন সে কথাই, “এই গ্রামে প্রথম যখন খেলাধুলা বা যোগ ব্যায়াম ও জিমন্যাস্টিকের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি তখন গ্রামের অনেক ছেলে মেয়েই নিজেদের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পায়। অনেক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি। আসতে আসতে অর্থের অভাবে সব বন্ধ হয়ে গেছে। প্রণতির মতো এক-আধজন হয়তো আজ এই গ্রাম থেকে উঠতে পেরেছে বা পারছে, এটাই আমাদের গর্ব! তবে, আর্থিক সহযোগিতা পেলে আরও অনেকেই হয়তো উঠতে পারবে। অর্থের অভাবেই, পেটের দায়েই আজ আমাকেও এসব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতে হচ্ছে!” প্রণতি’র সাফল্য তাই শুধু ১৩০ কোটি ভারতবাসীর স্বপ্ন পূরণ করবে এমনটাই নয়, আলোকিত করবে প্রত্যন্ত এরকম অনেক গ্রামকে, এটাই চন্দন বাবু’র মতো প্রত্যন্ত গ্রামের প্রশিক্ষকদের আশা!
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ নভেম্বর: সাপ ধরে বাড়িতেই পরিচর্যা করতেন। এলাকাবাসীদের কথায়,…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২১ নভেম্বর: পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসকদের…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ নভেম্বর: সংগ্রাম, আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদ। বরাবরই পথ দেখিয়ে…
শশাঙ্ক প্রধান, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ নভেম্বর: বাড়ির ভিত তৈরির জন্য চলছিল খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। খোঁজ মিলল…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ নভেম্বর: ৫ এম.এল, ১০ এম.এল-র সিরিঞ্জ থেকে অ্যাড্রিনালিনের…
দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৮ নভেম্বর: এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নলেজ…