দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, অখিলবন্ধু মহাপাত্র, ১৮ মার্চ:বাবর আলি। সারা বিশ্বের কাছে আজ এক সুপরিচিত নাম। পণ্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্ম জয়ন্তীর উত্তরকালে বাঙালির শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বোধহয় বাবর! মোগল সম্রাটের সাম্রাজ্যের চেয়েও তাঁরর ব্যপ্তি কয়েকগুণ। বিশ্বের কনিষ্ঠতম প্রধান শিক্ষক সেই বাবর আলির জন্ম ১৯৯৩ এর ১৮ মার্চ। মুর্শিদাবাদের গঙ্গাপুরে মোহম্মদ নাসির উদ্দীন এবং বানুয়ারা বিবির পরিবারের চার সন্তান সন্ততির মধ্যে অন্যতম বাবর। দেশে বিদেশে যাঁর জীবনকাহিনী এখন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত। আর তাঁর তৈরি আনন্দ শিক্ষা নিকেতন এখন শিক্ষাব্রতীদের কাছে এক পবিত্র তীর্থস্থান। কয়েকদিন আগে অন্তর্জাল ব্যবস্থায় আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষা প্রশাসনের আধিকারিক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং স্রষ্টা আমিনুল আহসান মহাশয়ের আন্তরিক ব্যবস্থাপনায় সুবর্ণ সুযোগ হয়েছিল বাবর আলির মুখ থেকে তাঁরই জীবনের কথা শোনার। শুধু কথা শোনা নয়, সুযোগ হয়েছিল তাঁর সাথে কথোপকথনের। আর কথাগুলো যতই শুনছিলাম ততই মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার গল্প গাঁথা। মুর্শিদাবাদ জেলা বা সংলগ্ন এলাকায় বাবর আলিকে নিয়ে চর্চা হলেও রাজ্য বা জাতীয় ক্ষেত্রে খুব বেশি চর্চা হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।

thebengalpost.net
বাবর আলি:

বাবর আলি আজকের সমাজে এক বিরল ব্যক্তিত্ব।
২০২০ এর ২৫ জানুয়ারি ভারতবর্ষের ৭১ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এদেশের মাননীয় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের ১৪ নং অনুচ্ছেদের একটি অংশে বলেন- ” Shri Babar Ali has been providing education to underprivileged children in West Bengal since his childhood. “। ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ওয়েব পেজ WIRED এ লেখা হল -” The nine-year-old who set up a school in his garden and transformed his community”- এই শিরোনামে দীর্ঘ এক ইংরেজি নিবন্ধ। যার পরতে পরতে বাংলার গর্ব বাবরের উপাখ্যান। এক সাধারণ মুসলিম পরিবারের এই কৃতি সন্তান মাত্র ৯ বছর বয়স থেকে শুরু করেন প্রধান শিক্ষকের কাজ।সালটা ২০০২। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পা রেখেছেন। সেদিনের সেই শিশু এক স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ভারতরত্ন প্রয়াত এ পি জে আব্দুল কালাম বলেছিলেন “স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরনের প্রত্যাশা, মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।” সেই স্বপ্নই ছিল বাবর আলির দু’চোখে। গঙ্গাপুর থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গা সি আর জি এস হাইস্কুলের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। ৮ কিলোমিটার বাসে, আর ২ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যেতে যেতেই স্কুলে না যাওয়া বহু ছেলে মেয়ে বাবরের নজর এড়াত না। সেই বয়সেই শুরু স্কুল খোলার পরিকল্পনা। ইংরেজিতে একটা কথা আছে “CHARITY BEGINS AT HOME”, শিশু বাবরের ক্ষেত্রেও ঘটলো একই ঘটনা। ৯ বছর বয়সী বাবর খেলার ছলে স্কুল শুরু করলেন। আর, প্রথম শিক্ষার্থী হলেন তাঁরই বোন আমিনা খাতুন। এক শৈশব আরও শৈশবকে আনতে চায় স্কুলের আঙিনায়। বাস্তবে হলও তাই। স্কুলের বুকলিস্ট হাতে পেয়েই সেদিনের শিশু বাবর দেখলেন তাতে বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির নাম রয়েছে। তাহলে স্কুল খুলতে গেলে পরিচালন কমিটি চাই! কমিটির আবার সভাপতি চাই! কে হবেন সভাপতি? এই চিন্তা নিয়েই বাবর সোজা চলে গেলেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর সদর মহকুমাশাসক সবুজবরণ সরকারের কাছে। এক শিশুর প্রস্তাবে দক্ষ মহকুমাশাসক ও রাজী হয়ে গেলেন। সবুজবরণ সেদিন হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন এই শিশুর সবুজ স্বপ্ন একদিন পিছিয়ে থাকা এলাকায় শিক্ষার অনির্বাণ দীপশিখা জ্বালাতে পারে। স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার সংকল্প গ্রহণের ভিত মজবুত হল সেদিনই। মহকুমাশাসকের রাজি হওয়া বাবরকে আরও আস্থা এনে দিল। একদিকে নিজের পড়া আর অন্যদিকে এলাকার স্কুল না যাওয়া শিশুদের শিক্ষার আলো বিতরণ একবিংশ শতাব্দীতে একটি অননুকরণীয় মহতি কর্ম প্রচেষ্টা, যার দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে বাবর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন। একই সঙ্গে চললো নিজের তৈরি স্কুল, যার নাম আনন্দ শিক্ষা নিকেতন। আনন্দ শিক্ষা নিকেতন এখন মুর্শিদাবাদের ভাবতা গ্রামে অবস্থিত।

thebengalpost.net
রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের সাথে বাবর আলি:

তবে, বাবরের চলার পথে অদম্য সাহস যুগিয়েছেন ভারত পথিক বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। বাবরের কথায়, “আমি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শকে সামনে রেখেই পথ চলতে শিখেছি। বহু বাধা, বিপদ এসেছে, আমি বাধা বিপত্তিকে জয় করেছি স্বামীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে।” মানুষের মনে জমে থাকা অন্ধবিশ্বাসকে শৈশব থেকেই ভাঙতে শিখেছেন বাবর। ক্রমে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ স্নাতক, পরে স্নাতকোত্তর অর্থাৎ এম.এ পাস করেন। এদিকে, ফলে পুষ্পে শোভিত হতে থাকে বাবরের আনন্দ শিক্ষা নিকেতন। ২০০৯ সালে ইংরেজি নিউজ চ্যানেল সি এন এন আই বি এন বাবরকে দেয় ‘Real Heroes of the Indian’ পুরস্কার। একই সময়ে বাবর আলিকে বিবিসি ‘বিশ্বে কনিষ্ঠতম প্রধান শিক্ষক’ ঘোষণা করে। ভারতের জনপ্রিয় খবরের চ্যানেল এনডি টিভি তাঁকে দেয় ‘Indian of the Year’ পুরস্কার। ২০১২ সালের জুলাই মাসে আমির খানের জনপ্রিয় টিভি শো ‘সত্যমেব জয়তে’ অনুষ্ঠানের বিষয় হন বাবর আলি। এরপর দেশ বিদেশের একের পর এক স্বীকৃত এবং পুরস্কার আসতে থাকে বাবর আলির হাতে। কর্ণাটক সরকার ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে বাবর আলির কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছে। বাবর আলির খ্যাতি সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ হাত বাড়িয়ে দেন বাবরের স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের সার্বিক উন্নয়নে। পশ্চিমবঙ্গ, ককর্ণাটক, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্যের বহু সংস্থা ও শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তি আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের সার্বিক উন্নয়নে সহযোগিতা করছেন বলে বাবর আলি জানালেন। রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের অনুমোদন নিয়ে এখন জোর কদমে চলছে পঠনপাঠনের কাজ। আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের মূল উদ্দেশ্য আনন্দ দায়ক পরিবেশে পাঠ দান। কয়েক দশক আগে এদেশের যশ পাল কমিটি যে সুপারিশ করেছিলেন সেই ‘JOY OF LEARNING’ কে গুরুত্ব দিয়ে প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের শিক্ষার আঙিনায় এনে কার্যত একটি বিপ্লব করছেন বাবর। শিক্ষার্থী হিসেবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অধিক গুরুত্ব দিতে উদ্যোগী বাবর। বাবর আলির এই বৈপ্লবিক কাজের ধারা নিয়ে উৎসুক মানুষের চাহিদা মেটাতে দেশে এবং বিদেশে অসংখ্য সেমিনারে বক্তব্য রাখতে যেতে হচ্ছে তাঁকে। তবে একাজে বাবর আলিকে উৎসাহ দিতে এখনো আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার প্রাক্তন সদস্যা বিধায়ক ফিরোজা বেগম। আবার, শুধু শিক্ষা দান নয়, অতিমারীর চরম দুঃসময়েও বাবর আলি এবং তাঁর ‘আনন্দ শিক্ষা নিকেতন’ আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভুল করেনি! করোনা আবহেও মানুষের সেবা করে গিয়েছেন অকাতরে। আসলে মানব প্রেমী বাবর আলির কাজে ও পরিকল্পনায় মেদিনীপুরের বীরসিংহের সিংহশিশু বিদ্যাসাগরের চরিত্রের অবয়ব অতি সহজে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে কবি কুসুম কুমারী দাশের সেই কবিতা লাইনের অবয়ব, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন, ‘মানুষ হইতে হবে’ – এই যার পণ৷” আজ তাঁর জন্মদিনে বাবর আলিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

thebengalpost.net
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সাথে বাবর আলি :