দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, অখিলবন্ধু মহাপাত্র, ৪ অক্টোবর: পুজোর দিনগুলিতে বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গন্তব্য বাংলার পিঠে পিঠ ঘেঁষে থাকা ওড়িশার প্রবেশদ্বার রাজা লক্ষ্মণনাথের মহাশয়গড়ের সুদৃশ্য রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ি। একদিকে সবুজ ছায়া সুনিবিড় বনানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা শান্ত স্নিগ্ধ সুবর্ণরেখা আর অন্য দিকে মহাশয় গড়ের সুবিশাল রাজবাড়ি। সেই সঙ্গে বনেদি দুর্গাপূজার আয়োজন। এসব কিছুর সাক্ষী থাকতে বেরিয়ে পড়ুন। দশমী পর্যন্ত যে কোনো একটি দিনকে নির্বাচন করলেই আপনি সাক্ষী হতে পারেন ৩০০ বছর পেরিয়ে যাওয়া এক ঐতিহাসিক দুর্গাপূজার। আর তারপরেই আবিস্কার করবেন এক আশ্চর্য অনুভূতি। গত টানা দু’বছর বন্ধ ছিল ঐতিহাসিক এই দুর্গাপূজা। নিয়ম রক্ষার ঘটপূজা সারতে হয়েছিল উদ্যোক্তাদের। প্রবেশ বন্ধ ছিল ঐতিহাসিক রাজবাড়ির ভেতরে। করোনা অতিমারীর সেই দুশ্চিন্তা কাটিয়ে এবছর আবার স্বমহিমায় আবির্ভূতা মৃন্ময়ী দেবী দশভুজা, মহাশয় গড়ের ঠাকুর দালানে। চোখ জুড়ানো মূর্তি আর পূজার আচার আপনাকে সম্মোহিত করবেই। তবে, তন্ময় হয়ে পূজার দৃশ্য উপভোগ করতে করতে অবশ্যই ভুলে যাবেন না, রাজবাড়ির ভেতরটা একবার ঘুরে আসতে! কারণ, এই রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ির পরতে পরতে আছে নানান কাহিনী। এই রাজকাহিনীরই কিছুটা অংশ জানিয়ে রাখি।

thebengalpost.net
রাজবাড়ির পুজো (আজ, নবমীর ছবি):

একসময় অজয় ও দামোদর নদের তীরবর্তী এলাকায় বাস করতেন শূর বংশীয় রাজারা। গোপভূম নামে একটি সমৃদ্ধশালী অংশের রাজা ছিলেন আদি শূর। সম্ভবত রাজা আদি শূর ছিলেন অপুত্রক। সেই কারণে আদি শূর ৯৯৬ খ্রীস্টাব্দে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন করেন। পুত্রেষ্টি যজ্ঞের জন্য কান্বকুব্জ বা কনৌজ থেকে ৫ জন ব্রাহ্মণ এবং ৫ জন কায়স্থকে নিয়ে আসেন। যজ্ঞের ফল লাভ হওয়ায়, আদি শূর উক্ত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের বিভিন্ন এলাকার জমিদার করে দেন। কায়স্থদের মধ্যে একজন ছিলেন মকরন্দ ঘোষ। মকরন্দ ঘোষ এবং তাঁর উত্তর পুরুষরা ছিলেন অত্যন্ত প্রজাবৎসল এবং জনপ্রিয় জমিদার। মকরন্দ ঘোষের ১৪ তম পুরুষ রামচন্দ্র ঘোষ ১৫০৮ খ্রীস্টাব্দে মোগল সম্রাট হোসেন শাহ এর কাছ থেকে ওড়িশার জলেশ্বরকে কেন্দ্র করে বিস্তীর্ণ এলাকার সদর কানুনগো বা জমিদারির দায়িত্ব লাভ করেন। ধর্মভীরু রাজা রামচন্দ্র ঘোষ তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা জলেশ্বরে একটি দূর্গামন্ডপ নির্মাণ করেন। যতদুর জানা যায়, নীলাচলে যাওয়ার পথে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব রাজা রামচন্দ্রের কাতর আবেদনে জলেশ্বরে অবস্থান করেন। পরে, রামচন্দ্র ঘোষ নিজে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে চন্দনেশ্বর হয়ে জল পথে পুরী যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রামচন্দ্র ঘোষকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “এই স্থান তোমার জন্য অনুপযুক্ত। তোমার এ স্থানে থাকা ঠিক হবে না।” মহাপ্রভুর এই ভবিষ্যদ্বাণী কার্যত ফলে যায় বাস্তবে। ধর্মাচরণ এবং সমাজসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করায় নবাবকে সময় মতো কর দিতে অপারগ হন রামচন্দ্র ঘোষ। নবাব রামচন্দ্র ঘোষ এবং তাঁর কয়েকজন অনুগামীকে বন্দী করেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় রামচন্দ্র ঘোষকে স্বপ্নাদেশ দেন পরিবারের কূলদেবী শ্যামাসুন্দরী। স্বপ্নাদেশে দেবী রামচন্দ্র ঘোষকে বলেন, “নিজে বন্দী থেকে অন্যদের মুক্তির ব্যবস্থা কর।” নিজের বেশ কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে কুলদেবীর স্বপ্নে দেওয়া আদেশকে মান্যতা দিয়ে অন্য বন্দীদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন। এই সংবাদ নবাবের কানে যেতেই হোসেন শাহ্ রামচন্দ্র ঘোষকে মুক্তি দেন এবং তাঁকে ‘মহাশয়’ উপাধিতে ভূষিত করেন। রামচন্দ্র ঘোষ হয়ে যান রামচন্দ্র মহাশয়।

thebengalpost.net
নবমীতে সমাগম: (নিজস্ব চিত্র)

রামচন্দ্র মহাশয়ের পরেও কয়েক পুরুষ জলেশ্বরের সদর কানুনগো’র দায়িত্ব পালন করেন। এই মহাশয় পরিবারের এক উত্তরসূরী লক্ষ্মীনারায়ণ মহাশয়ের শাসনকালে গোটা দেশ চলে যায় বৃটিশের হাতে। জলেশ্বর এলাকাও একইভাবে অধিকার করে নেয় ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ সরকার জলেশ্বরের সদর কানুনগো মহাশয়দের ‘রায় মহাশয়’ উপাধি দেয়। আর ব্রিটিশ আমলেই ঘটে এক চরম বিপর্যয়। কালাপাহাড়ের পরবর্তী, হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী দুর্মতি মহম্মদ তোকী বাংলা ওড়িশার ধর্মস্থান গুলিতে ব্যপক তাণ্ডব চালায়। তার থেকে মুক্তি পেতে লক্ষ্মীনারায়ণ রায় মহাশয় এবং তাঁর পরিবার লক্ষ্মণ নাথ নামে জঙ্গলাকীর্ণ সুবর্ণরেখার তীরবর্তী এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। গবেষকদের মতে লক্ষ্মণ নাথ এক ব্যক্তির নাম ছিল। তিনি পেশায় ছিলেন তোষক, বালিশ, লেপ, কাঁথা ইত্যাদির কারিগর। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় যুগি বা যুগিয়া। তাঁর কোন কীর্তির কথা স্মরণ করে রাখতেই এই গ্রামের নাম লক্ষ্মণ নাথ। ১৭২০ খ্রীস্টাব্দের আগে জলেশ্বর থানার অন্তর্গত লক্ষ্মণ নাথে লক্ষ্মীনারায়ণ রায় মহাশয় দুই একর জমির উপর সুবিশাল রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। যা লক্ষ্মণ নাথের ‘মহাশয়গড়’ নামে পরিচিত। এই রাজবাড়ির বাইরে এবং ভিতরের অংশে রাজকীয় অবয়ব বিদ্যমান। রাজবাড়ির অভ্যন্তরে ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির মতো ৭ টি উঠোন, প্রায় ৬০ টি কক্ষ, ১৫০ টি দরজা, ২০০ টি জানালা। বিশাল এই প্রাসাদোপম রাজবাড়ির চৌহিদ্দীতে ছিল হাতিশাল, ঘোড়াশাল এবং গোশালাও। এখনও ৪৮ টি কক্ষ, ১৫৮ টি জানালা, ১১০ টি দরজা রয়েছে। তবে অতীতের মতো রাজবাড়ির ভেতরেই রয়েছে কুলদেবী শ্যামা সুন্দরীর সুদৃশ্য মন্দির, রাস মঞ্চ এবং অবশ্যই দুর্গাপূজার জন্য রাজকীয় ঠাকুর দালান।

thebengalpost.net
রাজবাড়ির অলিন্দে :

পরিবারের মহিলারা যাতে রাজবাড়ির ভেতরে থেকে দেবী দশভুজার আরধানার প্রতিটি আচার দেখতে পারেন সে জন্য ঠাকুর দালানে সামান্য উচ্চতায় রয়েছে ব্যালকনি। সকলে যাতে দেবীর দর্শন লাভ করতে পারেন সেজন্য দেবী দশভুজার মূর্তিও হয় বিশাল আকার। এত বৃহৎ মূর্তি ভাসানের সময় বের করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মূর্তির কাঠামোর নীচে কাঠের চাকা লাগানোর ব্যবস্থা থাকে। পূজার আচারেও রাজবাড়ির ঐতিহ্যের ছাপ এক্কেবারে স্পষ্ট। বহুকাল আগে নবমীর দিন এখানে মহিষ বলি হত। এখন মহিষ বলি হয়না। পূজার দিনগুলোতে বাজত নহবত। এজন্য রাজবাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম অংশে, দক্ষিণ মুখী দুর্গা মণ্ডপের বিপরীতে রয়েছে নহবতখানা এবং বলির স্থান। নহবত আজ আর সুর তোলে না! তবুও, ঐতিহ্যের এই দুর্গাপূজায় জনস্রোতে প্লাবিত হয় গোটা এলাকা। রাজবাড়ির সামনে রয়েছে ৮ টি সারিবদ্ধ শিবের মন্দির এবং অন্নপূর্ণা মন্দির। মন্দিরগুলি একটি পুকুর পাড়ে অবস্থিত। এই মন্দিরের বিপরীতে রয়েছে জগন্নাথ দেবের মন্দির। মন্দিরগুলির পাশেই রয়েছে বিশাল মাঠ। দুর্গাপূজার সময় এই মাঠেই মেলা বসে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওড়িশার প্রবেশদ্বার লক্ষ্মণনাথে লক্ষ মানুষের ভিড় হয়। দুর্গাপূজার সময় খুলে দেওয়া হয় রাজবাড়ির ভিতরের কিছুটা অংশ। রাজবাড়ির ভিতর ও বাইরে থাকা মন্দির গুলিতে নিত্যপূজা হয় আজও। রাজবাড়ির ভেতরে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বই নিয়ে একটি গ্রন্থাগার। আসলে ওড়িশা রাজ্যে অবস্থিত হলেও দুর্গাপূজা এবং লক্ষ্মীপূজা হয় বাংলা পঞ্জিকা মতে, সম্পূর্ণ বাঙালির আচার মেনে। এমনকি লক্ষ্মীনারায়ণ রায় মহাশয়ের উত্তরসূরীরাও থাকেন কলকাতার লেকটাউনে। দুর্গাপূজার সময় তাঁরাও আসেন। লক্ষ্মীনারায়ণ রায় মহাশয়ের উত্তরসূরীরা ‘মহাশয়’ শব্দটি বাদ দিয়ে পদবীতে শুধু রায় ব্যবহার করেন। একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, এই রাজবাড়ি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন লক্ষণনাথ গ্রামের প্রবীন বাসিন্দা ক্ষেত্রমোহন সিনহা। রাজবাড়িতে পৌঁছে অবশ্যই ক্ষেত্রমোহন সিনহার খোঁজ নিয়ে নিবেন। এছাড়া, রাজবাড়ী ঘুরিয়ে দেখতে সাহায্য করবেন আরও একজন তিনি হলেন গোপাল চট্টোপাধ্যায়।

thebengalpost.net
রাজবাড়ির অলিন্দে:

কিভাবে পৌঁছাবেন? দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়ের হাওড়া স্টেশন থেকে জলেশ্বর বা ভদ্রক যাওয়ার ট্রেনে চেপে বাংলা সীমান্তে ওড়িশা রাজ্যের প্রথম স্টেশন লক্ষণনাথরোডে নেমে পশ্চিমে সাত কিলোমিটার যাওয়ার জন্য অটো বা টোটো ধরে লক্ষ্মণনাথে পৌঁছে যান। অথবা হাওড়া কিংবা খড়্গপুর থেকে দক্ষিণ ভারতগামী যে কোন ট্রেনে জলেশ্বর পৌঁছে, সেখান থেকে অটো বা টোটোতে মাত্র ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিন। লক্ষ্মণনাথরোড স্টেশনে সব ট্রেনের স্টপেজ নেই। এছাড়া সড়ক পথে কলকাতা বা খড়্গপুর থেকে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণচতুর্ভুজের জাতীয় সড়ক ধরে লক্ষ্মণনাথ রোড, সেখান থেকে সোজা লক্ষ্মণনাথ। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে হয় ফিরে আসুন, আর না হলে থেকে যান জলেশ্বর কিংবা সোনাকোনিয়া সংলগ্ন জাতীয় সড়কের ধারে কোন হোটেলে। মন ভালো করা গোটা দিন যাপন আপনাকে এক অন্য অনুভূতিতে সম্মোহিত করবেই। আর যদি দুর্গাপূজার সময় লক্ষ্মণনাথে যান তাহলে তা হবে এক অনন্য প্রাপ্তি এবারে দুর্গাপূজায়। (ছবি ও প্রতিবেদন- শিক্ষক ও সাংবাদিক অখিলবন্ধু মহাপাত্র)

thebengalpost.net
রাজবাড়ির অলিন্দে:

thebengalpost.net
ঐতিহ্য ও ইতিহাসের মেলবন্ধন: