মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৭ ডিসেম্বর: “মন রে কৃষিকাজ জানো না/ এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।” সাধক রামপ্রসাদ সেনের এই স্মরণ-সুন্দর গানই কবি শ্রীজাত’র প্রথম ছবি ‘মানবজমিন’ (Manobjomin) এ যেন এক নতুন প্রাণ পেয়েছে শিল্পী অরিজিৎ সিং- এর অসাধারণ কন্ঠে। পর্দার ‘মানবজমিন’ এর মূল সুরও ‘মানব’ রূপী ‘জমিন’ এ ‘সোনার ফসল’ ফলানো। সভ্যতার আলোকবর্তিকা থেকে বঞ্চিত আদিম, অন্ত্যজ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কিংবা প্রত্যন্ত, পিছিয়ে পড়া এলাকায় ‘শিক্ষার আলো’ পৌঁছে দেওয়ার মধ্য দিয়েই যে তা সম্ভব, তা মনে করেছেন পরিচালক শ্রীজাত থেকে প্রযোজক রানা সরকার’রা। ছবিতে দেখানো হয়েছে, একদিকে স্বর্গের জমি কেনার সখ, অন্যদিকে প্রত্যন্ত এলাকায় টাকার কারণে আটকে যাচ্ছে কচিকাঁচাদের জন্য স্কুল তৈরির প্রচেষ্টা! গল্পের সেই ‘প্রচেষ্টা’কেই বাস্তব রূপ দিতে শ্রীজাত সহ ‘টিম মানবজমিন’ বেছে নিয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের ভাদুতলা সংলগ্ন পীরচক গ্রামটিকে।

thebengalpost.net
‘টিম মানবজমিন’ এর উদ্যোগ :

জঙ্গলের মাঝখানে ১৩-টি লোধা-শবর পরিবারকে নিয়ে গড়ে ওঠা এই গ্রামে পৌঁছয়নি সেই অর্থে শিক্ষা কিংবা সমৃদ্ধির আলো। ফুটফুটে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেশিরভাগ জনই জঙ্গল পেরিয়ে স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি। তবে, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্লক প্রশাসন, পঞ্চায়েত সমিতি থেকে শুরু করে চুনী কোটাল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট কিংবা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো একাধিক সংস্থা। এবার, তাঁদের হাত শক্ত করতেই মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়া’র মধ্যস্থতায় এবং চুনী কোটাল চ্যারিটেবল ট্রাস্টের সহযোগিতায় পীরচক গ্রামে ‘মানবজমিন অবৈতনিক বিদ্যালয়’ এর শিলান্যাস হল শনিবার পড়ন্ত বিকেলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবি ও শিল্পী শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম ছবি ‘মানবজমিন’ মুক্তি পাবে (রিলিজ হবে) কিছুদিনের মধ্যেই। ইতিমধ্যে, সিনেমার অফিসিয়াল টিজার প্রকাশিত হয়েছে। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়াঙ্কা সরকার, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। টিজারে দেখা যাচ্ছে, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বর্গের জমি কেনার প্রস্তাব দিচ্ছেন দুই ব্যক্তি। অন্যদিকে, একটি বাচ্চাদের স্কুলে নানা কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে পরমব্রত এবং প্রিয়াঙ্কাকে। কাহিনী’র মূল সুর স্কুল ছুট পড়ুয়াদের স্কুলে ফেরানো কিংবা পিছিয়ে পড়া এলাকায় বাল্যবিবাহ বা নাবালিকাদের বিয়ে বন্ধ করে তাদের স্কুল মুখী করার প্রচেষ্টা। অন্যদিকে, শালবনীর শবর অধ্যুষিত পীরচক গ্রামও অশিক্ষা, অসচেতনতার অন্ধকারে ডুবে! বাড়ির কর্তারা নেশায় আসক্ত। অন্নের সংস্থান করতে হয় মহিলাদেরই। সকাল থেকে জঙ্গলের কাঠ কুড়িয়ে কিংবা দীনমজুরি করে তাঁরা সংসার টেনে নিয়ে যান। অশিক্ষার অন্ধকারে তলিয়ে যায় কচিকাঁচারা। তবে, তাদের আলোয় ফেরানোর চেষ্টায় অবশ্য কার্পণ্য করেননি মেদিনীপুর জেলার একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে সমাজকর্মীরা। সম্প্রতি, মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারো আগে বিদ্যাসাগর ফাউন্ডেশনের প্রবীর কুমার লায়েক দীর্ঘ সময় ধরে পীরচক গ্রামের কচিকাঁচাদের পাঠদান করেছেন, তাদের আত্মিক বিকাশের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এবার, চুনী কোটাল চ্যারিটেবল ট্রাস্টের সহযোগিতায় ‘টিম মানবজমিন’ এর পক্ষ থেকে এই গ্রামকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

thebengalpost.net
শিলান্যাস:

সেজন্যই, শনিবার সুদূর কলকাতা থেকে ‘পীরচক’ গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন কবি, সঙ্গীতশিল্পী ও সিনেমার পরিচালক শ্রীজাত, সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকার, প্রযোজক রানা সরকার, অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা সরকার, সমাজকর্মী দেবপ্রিয়া ঘোষ গোস্বামী প্রমুখ। তাঁরা এদিন গ্রামের অসহায় মানুষগুলির হাতে নতুন বস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রীও তুলে দিলেন। বললেন, “পর্দার মানবজমিন তো তখনই সার্থক হবে, যখন পীরচকের মতো অন্তত একটি গ্রামকেও আমরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারব!” তাঁরা এও জানান, ‘চুনী কোটাল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ এর সম্পাদক তথা শবর সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা স্নাতক প্রয়াত চুনী কোটালের ভাইপো মৃণাল কোটালের মাধ্যমেই তাঁরা এই গ্রামের কথা জানতে পেরেছিলেন। এদিনের অনুষ্ঠানে মৃণাল ছাড়াও ছিলেন শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ সন্দীপ সিংহ, শিক্ষক ও সমাজকর্মী বিপ্লব আর্য, শেখ ইমরান, সৌমেন ঘোষ প্রমুখ। তবে, ‘মধ্যমণি’ হিসেবে অবশ্যই ছিলেন টলিউডের স্বনামধন্য শিল্পী তথা মেদিনীপুরের জনপ্রিয় বিধায়ক জুন মালিয়া। তিনি বললেন, “ওঁরা চেয়েছেন শালবনীর এই পীরচক গ্রামে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটুক। তাই, শ্রীজাত আর রানা একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন! আমি সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত রকম সহযোগিতা ও পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলাম। এভাবেই, এগিয়ে চলুক পীরচকের মতো গ্রামগুলি, বাস্তবের মানবজমিনেও সোনা ফলুক।”

thebengalpost.net
পীরচক গ্রামে চাঁদের হাট :