দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ড. শুভেন্দু ঘোষ: বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণ মরুভূমি সাহারা (Sahara Desert)’র ক্রমবর্ধমান মরুকরণ ও মরুভূমির প্রসার নিয়ে যখন বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত, ঠিক সেই সময়ই একটি উপগ্রহ চিত্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপী গাছপালার অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি, যা মরুভূমি সম্পর্কে স্বাভাবিক ধারণার পরিপন্থী। কিন্তু, কেন এই অসংখ্য বৃক্ষ রাশির অস্বাভাবিক উপস্থিতি? এই ঘটনা কিসের ইঙ্গিত? তবে কি বিশেষজ্ঞদের সিংহভাগই এই ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে বর্ণনা করছেন?

thebengalpost.net
উপগ্রহ চিত্র :

এখন থেকে বছর ১১০০০-৫০০০ বছর সময়কালে বরফ যুগ শেষ হওয়ার পর, সবুজ সাহারার শুষ্ক মরুভূমিতে রূপান্তর ঘটে। বর্তমান সবুজের খোঁজ সাহারার জলবায়ুর পরিবর্তন ও পূনরায় সেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ারই লক্ষ্মণ বলে ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন। যদিও দীর্ঘকালীন জলবায়ুর এই রূপান্তর পৃথিবীর ক্রমাগত পরিবর্তিত কক্ষপথে ঘূর্ণনের ফলে সংঘটিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ভৌগোলিক আরভিন এর মতে, প্রতি ২৩০০০ বছরে জলবায়ুর এই রূপান্তর সম্পূর্ণ হয়। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ বিজ্ঞান বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক ডঃ মার্টিন ব্র্যান্ডট সহ ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার মোট ২৪ জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ গবেষক দলের সমীক্ষায় উঠে আসা এই বাস্তব সত্য জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণায় এক নুতন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। প্রায় ১১ হাজার উচ্চ মানের উপগ্রহ চিত্রের বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে ১.৩ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন সংখ্যায় বৃক্ষের সমারোহ রয়েছে।

thebengalpost.net
সবুজের সমারোহ?

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৯২০ থেকে এই সময় পর্যন্ত সাহারার আয়তন প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন মতও রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ১৯৭০ – ৮০ দশকে সাহারা সংলগ্ন সমগ্র সাহেল অঞ্চলজুড়ে ভয়ঙ্কর খরার পাদুর্ভাবে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে সবুজ ধংস হয়েছিল, তাতে অনেকেরই মনে হয়েছিল যে বোধহয় সাহারা মরুভূমি পরিসর ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আসলে প্যালিও -ক্লাইমেটিক সময় থেকে অর্থাৎ ১০০০০০০-১০০০০০ বছর এর মধ্যে সৌর বিকিরণ এর পার্থক্যের কারণে মরুভূমির আকার আয়তনে পরিবর্তন হয়েছে। উল্লেখ্য, এখন থেকে প্রায় ১১ হাজার থেকে ৮ হাজার বছর আগে সাহারা মরুভূমিও সবুজে পরিপূর্ণ নদীমাতৃক অঞ্চল রূপে পরিচিত ছিল। প্রায় ৪০০০ বছর আগে পৃথিবীর কক্ষপথের হেলানো অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন সুচনা হয় এবং ধীরে ধীরে পৃথিবীর উষ্ণতম বৃহৎ মরুভূমি সাহারার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

thebengalpost.net
আফ্রিকা মহাদেশ:

পশ্চিম আফ্রিকার অবস্থিত ITCZ প্রকৃতপক্ষে সাহারাতেই উদ্ভুত, উত্তর পূর্ব দিকে প্রবাহিত স্থানীয় বায়ু ‘হারমাট্টান’ এবং আটলান্টিক মহাসাগর থেকে উদ্ভুত দক্ষিণ -পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সংযোগ ঘটে, যা স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটায় এবং দঃপশ্চিম সাহারায় কিছুটা বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে সাহারা সংলগ্ন সাহেল অঞ্চলটি (১৪°উঃ-১৮°উঃ) অপেক্ষাকৃত আর্দ্র। পূর্ব -পশ্চিমে প্রায় ৫০০০কিমি বিস্তৃত এই অঞ্চলটি বৃক্ষ সংযোগে তৃনভূমি হিসেবে পরিচিত। সাহেলের উত্তরে সাহারা সংলগ্ন অংশে ১০০-২০০মিমি এবং দক্ষিনে ৫০০-৬০০ মিমি বৃষ্টিপাত ঘটে। উল্লেখ্য, এখানে লাউ কুমড়ো জাতীয় ফসলও উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে সাহারাতে যে সবুজের সন্ধান মিলেছে তাতে মূলত শুষ্ক মরু অঞ্চলের জন্মানো বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ জলপাই খেজুর,থাইম, তেতুল, বাবলা, পাম প্রভৃতি।

thebengalpost.net
সাহারা মরুভূমি:

সাহারা মরুভূমির উত্তরে শুষ্ক উপক্রান্তীয় জলবায়ুতে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। এখানে বাৎসরিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে শীতল শীতকাল বিরাজমান। ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে, সাহারার দক্ষিনে শুষ্ক ক্রান্তিয় জলবায়ুতে বার্ষিক বৃষ্টি মাত্র ৫ ইঞ্চি। ক্রান্তিয় ও উপক্রান্তীয় উভয় জলবায়ুতেই থান্ডারস্ট্রমের যথেষ্টই প্রভাব রয়েছে। সাহারার দক্ষিনে সাহেল অঞ্চল মরুভূমির জলবায়ুতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। মহাদেশীয় অবস্থানে বায়ুর ক্রমাগত সঞ্চালন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই সকল অঞ্চলেও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে।

thebengalpost.net
ভৌগলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত:

গ্রীষ্মের মাসগুলিতে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে সৌর বিকিরণ বৃদ্ধি পায়, যা আফ্রিকায় বর্ষাকে দীর্ঘায়িত করে, স্থলভাগ ও সমুদ্রের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে এই অঞ্চলে পশ্চিম আফ্রিকীয় মৌসুমি(WAM) বায়ুর পরিবর্তন ঘটে এবং যথেষ্ট শক্তিশালী হয়। সাহারার উপর বর্ধিত তাপ একটি নিম্নচাপ বলয় তৈরি করে যা আটলান্টিক মহাসাগর থেকে অনুর্বর শুষ্ক মরুভূমিতে আর্দ্রতা নিয়ে আসে। অপরদিকে, খনিজকনা ও ধুলিকনা সমৃদ্ধ শুষ্ক বায়ু আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত হয়। ন্যাশনাল ওসেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA) মতে এই বর্ধিত আর্দ্রতা পূর্বের বালুকাময় সাহারাকে ক্রমশ ঘাস এবং গুল্ম-ঢাকা স্টেপে রূপান্তরিত করছে। যাই হোক,একথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান শিল্পসভ্যতায় ক্রমাগত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন তরান্বিত হয়েছে — বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণ মরুভূমি পৃথিবীর অক্ষ ও কক্ষপথের কোন (Angle) পরিবর্তনের সঙ্গে ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে। (লেখক ড. শুভেন্দু ঘোষ বিশিষ্ট পরিবেশবিদ তথা পরিবেশ গবেষণা সংস্থা TIEER এর গবেষক।)