দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, মণিরাজ ঘোষ, ২৭ ডিসেম্বর: ঘরে ঘরে ‘পরকীয়া’ রূপ ‘বিষবৃক্ষ’ এর চাষ আগেও ছিল, এখন তা আরও বেড়েছে! বালির নিশ্চিন্দা’র দুই গৃহবধূর রাজমিস্ত্রিদের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া কিংবা প্রকাশ্যে ‘ভালোবাসা’র কথা স্বীকার করার ঘটনায় উত্তাল হয়েছে গোটা রাজ্য! আর, এই সময়ের মধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়েও যেন পরকীয়ার ছড়াছড়ি! শুধুই কি পরকীয়া, তা থেকে খুন-হত্যা-অপরাধ প্রভৃতিও আছে। গত ৩ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর, এই ২০ দিনের মধ্যে অন্তত দশ-দশটা এরকম ঘটনাই ঘটে গেছে! যার সর্বশেষ সংযোজন, পিংলা থানার কড়কাই ৪ নং অঞ্চলের জগন্নাথপুরের পায়েল ভৌমিক নামে এক গৃহবধূ’র সন্তান নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা। তাও আবার রীতিমতো জানালা ভেঙে! জানা গেছে, গত ৯ ডিসেম্বর নিজের সন্তানকে নিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছেন এই গৃহবধূ। পরবর্তী সময়ে, শ্বশুরবাড়ির তরফে থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। তবে, বিষয়টি সামনে আসে সোমবার (২৭ ডিসেম্বর), যখন ওই গৃহবধূর স্বামী এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেন এবং সমাজ মাধ্যমে ‘সন্ধান চাই’ পোস্ট করেন। তিনি কাতর আবেদন করে (হিন্দিতে) লিখেছেন, “এদের (স্ত্রী ও সন্তানকে) খুঁজে দিলে ৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে”! ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পিংলা থানার পুলিশ। অন্যদিকে, গত ২৩ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া পিংলার দনীচকের গৃহবধূ সুদেষ্ণা মাইতি-কে গড়বেতার কাদড়া এলাকা থেকে শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে পিংলা থানার পুলিশ। তবে, তার আগেই অবশ্য সুদেষ্ণা তার প্রেমিককে বিয়ে করে নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে! ফিরে আসার পরও শ্বশুরবাড়ি ফিরতে চায়নি সুদেষ্ণা; আপাতত বাপের বাড়িতে আছে বলেই জানা গেছে। পিংলা’র ওই দুই গৃহবধূর ক্ষেত্রেই দু’টো বিষয়ে গভীর মিল আছে। দু’জনের স্বামীই কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেন। পায়েলের স্বামী ভিন রাজ্যে (অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদে) এবং সুদেষ্ণা’র স্বামী ভিন জেলায় (হাওড়ায়) কাজ করতেন। সেই সুযোগেই হয়তো মোবাইল ফোন আর সমাজ মাধ্যমের (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ প্রভৃতি) দৌলতে তৈরি হয় প্রেমের সম্পর্ক। দ্বিতীয়ত, দুই মহিলাই এর আগেও নাকি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন! অন্যদিকে, দিন কয়েক আগে (গত ১১ ডিসেম্বর), পিংলার উত্তরবাড়ের পূজা জানা নামে যে গৃহবধূ নিজের দু’বছরের শিশুকন্যা-কে খুন করেছিলেন, নিজের প্রেমিকের সঙ্গে পরামর্শ করে, তাঁর স্বামীও কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেন। শুধু পিংলা নয়, গত কয়েকদিনে সবং (সম্পর্কিত বউদির প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা), ঘাটালের ক্ষীরপাই (প্রেমিকের সঙ্গে যোগসাজশে স্বামীকে খুন), শালবনীর শিরষি (পরকীয়ার জেরে স্বামীর হাতে প্রেমিক খুন), মোহনপুরের পুরুনিয়া (প্রেমিকের হাত ধরে স্ত্রী নিখোঁজ), দাসপুর, গড়বেতা প্রভৃতি এলাকায় উঠে এসেছে ‘পরকীয়া তত্ত্ব’! রাজমিস্ত্রি কান্ডের পর পরই হঠাৎ করে জেলাজুড়ে পরকীয়ার এই ঝড় ওঠায়, তাজ্জব অনেকেই। তবে, আবাক নন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থেকে সামাজকর্মী, লেখক, সাহিত্যিকেরা। তাঁরা বরং এর সঠিক কারণ অন্বেষণ করে, উপযুক্ত ব্যাখা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রসঙ্গত, সেই উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতেই ‘সাহিত্য সম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ তাঁদের ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) কিংবা ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে নারী মনের গোপন কথা (আঁতের কথা) বের করে দেখিয়েছেন! বঙ্কিম এও উল্লেখ করেছেন, “চিত্তসংযমের অভাবেই” এই পরকীয়া রূপ বিষবৃক্ষের চাষ হয় ঘরে ঘরে। অপরদিকে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চোখের বালি’-তে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, সমস্ত রকমের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও (বিনোদিনী), না পাওয়ার বেদনা থেকে নারী হৃদয় কতখানি হিংস্র হয়ে উঠতে পারে! আর, নারীর কামনার আঁচল তলে মহেন্দ্র’র পুরুষগুলিও যে কতখানি ‘অসহায়’ রূপে ধরা দেয়, তাও দেখিয়েছে! রবিবার সন্ধ্যায়, জেলাজুড়ে গত কয়েকদিন ধরে খবরের শিরোনামে উঠে আসা এই প্রেম-পরকীয়া আর অপরাধের বিষয়গুলি নিয়ে আমরা যখন একে একে কথা বলছিলাম, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কাবেরী ভট্টাচার্য, মেদিনীপুর কলেজ (স্বশাসিত) এর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড. সুস্নাত জানা কিংবা সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী রোশেনারা খান প্রমুখদের সাথে, তখন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যেন সেই কামনা স্বরূপ আদিম প্রবৃত্তি আর বর্তমান সমাজের অতি-আধুনিকতা আর মূল্যবোধ হীনতার দিকটিই প্রকট হয়ে উঠছিল, এসবের কারণ হিসেবে। তার সাথে অবশ্যই, অভাব-অনটন তথা বর্তমান আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের দিকটিও উঠে এসেছে! অতিমারীর করাল গ্রাসে কর্মহীন হয়ে পড়া স্বামীরা তাঁদের স্ত্রী বা পরিবারের ‘চাহিদা’ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অন্যদিকে, মোবাইল আর ফেসবুকে-হোয়াটসঅ্যাপে আসক্ত স্ত্রী’রা রঙিন দুনিয়ার প্রলোভনে আসক্ত হয়ে আগুনে ঝাঁপ দিতে বা বিকল্প খুঁজে নিতে দ্বিধাবোধ করেছেন না। একদিকে, যেমন তাঁকে নানা লোভ বা স্বপ্ন দেখাচ্ছে উল্টো প্রান্তের প্রেমিক বন্ধুটি, ঠিক তেমনই তাকে উস্কানি দেওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে সন্ধ্যাবেলায় টিভি চ্যানেলগুলোতে চলা ত্রিকোণ বা চতুষ্কোণ প্রেমের বাংলা সিরিয়ালগুলিও! বলাই বাহুল্য, এসব ক্ষেত্রে পুরুষের ‘বহুগামিতা’র দিকটিও সমানভাবে দায়ী। মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক সুস্নাত জানা যেমন নির্দ্বিধায় বললেন, “আমি নিজে তমলুক থেকে মেদিনীপুর অবধি প্রায়ই বাসে যাতায়াত করি! প্রায় প্রতিদিনই লক্ষ্য করি, এই মোবাইল নামক বস্তুটি দিয়ে কিভাবে বাসের সিটে বসে বসেই ভিডিও কল করছেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। তা করতেই পারেন, তবে অনেকক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি সম্পর্কগুলো ঠিক সহজ নয়। মানে ঠিক প্রেমের বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নয়! অতি সহজেই এরকম যোগাযোগের মাধ্যম এসে যাওয়ায়, নিজেদের চাওয়া-পাওয়া, ক্ষোভ-অভিমানগুলো যেন অন্য কোথাও গিয়ে মুক্তি পেতে চাইছে। সবথেকে বড় কথা খুব সহজেই ছেলে-মেয়েরা বিকল্প খুঁজে নিচ্ছেন এই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে! সহনশীলতা, সংযম বা নীতি-নৈতিকতার এখন আর বালাই নেই।”
অন্যদিকে, পশ্চিম মেদিনীপুরের স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী রোশেনারা খান আবার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ঈদ (Id), ইগো (Ego), সুপার ইগো (Super Ego) তত্ত্বের সঙ্গেই আইনের ফাঁক-ফোঁকরগুলির কথা তুলে ধরলেন, তাঁর সুলোলিত বাচনভঙ্গিতে। তিনি বললেন, “আমরা জানি আমাদের মনের ভেতরে থাকা গোপন ও অবৈধ কামনা-বাসনাগুলিকে চালিত করে ঈদ। কিন্তু, ইগো’র সাথে তার সংঘর্ষ চলে, আর সুপার ইগো এর মীমাংসা করে মূল্যবোধের উপদেশ দিয়ে! কিন্তু, এখন এই ইন্টারনেট, সমাজ মাধ্যম আর অপসংস্কৃতির প্রচার করা টিভি-সিরিয়ালের যুগে সেই মূল্যবোধই বিলীন হয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে”। তিনি এও স্পষ্ট করলেন, “আইন পুরুষ ও নারীর জন্য সমান হওয়া উচিত। রাজমিস্ত্রি কান্ডে ওই গৃহবধূদেরও সমান শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল, কারণ তাঁরা নাবালিকা নন। আইনের প্রতি ভয় নেই বলেই, মেয়েদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা যে এক নয়, তা নারীদেরও বোঝা উচিত”। অপরদিকে, প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন মনোবিদ তথা মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রধান ডাঃ কাবেরী ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, “প্রেম-পরকীয়া আগেও ছিল, এখনও আছে। এর পেছনে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণের বিষয়টিতো আছেই, তবে গৃহবধূরা যখন সন্তান-কে খুন করার মতো মারাত্মক অপরাধ করছেন বা খুন করার চেষ্টা করছেন, তার পেছনে থাকে সাইকোসিস বলে একটি রোগ! যেখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে মেয়েরা খুন করেন। এক্ষেত্রে, সন্তানদের হত্যা করে নিজেরাও অনেকসময় আত্মহত্যা করেন মায়েরা! অন্যদিকে, খুঁজতে হবে ওই গৃহবধূর অতীত জীবন কেমন ছিল, তাও। পূর্বেও তিনি এই ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্ম করেছেন কিনা বা সেই ধরনের পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন কিনা তা লক্ষ্য করতে হবে। এসবের সাথে অবশ্যই উত্তরোত্তর বেড়ে চলা লোভ-লালসা প্রভৃতি আছে। একটু ভালো থাকার জন্য অথবা আরও একটু ভালো থাকার লোভে অনেকসময় মেয়েরা পরকীয়া বা অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন”। তবে, এর শেষ কোথায়? এ’সবের ফলে সমাজ ‘আধুনিক’ হচ্ছে নাকি উচ্ছন্নে যাচ্ছে? উত্তর দেবে ভবিষ্যতই।