দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, মণিরাজ ঘোষ, ১৬ অক্টোবর: পৌরাণিক মতে, দেবী দুর্গা (পার্বতী)’রই অপর রূপ জগদ্বাত্রী। শরৎ এর শেষে হেমন্তে তাঁর আগমন, তাই তিনি হৈমবতী। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থেও তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে, জগদ্ধাত্রী’র আরাধনা বিশেষত বঙ্গদেশেই প্রচলিত। কথিত যে, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় এই পূজার সূচনা করেছিলেন। সেজন্যই এখনও, নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী উৎসব জগদ্বিখ্যাত। বিখ্যাত হুগলি’র চন্দননগরের জগদ্বাত্রী পূজাও। সেই হুগলি’র আরামবাগের জমিদার দ্বারিকানাথ ঘোষ আনুমানিক ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরে এসে এই পূজার শুরু করেছিলেন। প্রায় ২৭০ বছরের এই পুজো’ই মেদিনীপুর শহরের সর্বপ্রাচীন জগদ্বাত্রী পূজা রূপে খ্যাত। মেদিনীপুর শহরের মীরবাজারের ঘোষবাড়ির পুজো। প্রথা মেনে, গতকাল (শুক্রবার), বিজয়া দশমীর দিন অর্থাৎ দেবী দুর্গা বা উমা’র বিসর্জনের দিনই দেবী জগদ্বাত্রী বা হৈমবতী-কে আবাহন জানানো হল। মৃন্ময়ী উমা’র বিগলিত শরীরের মাটি ছুঁইয়েই হৈম’র মৃন্ময়ী মূর্তি গড়া’র সূচনা করা হল। দ্বাদশী (রবিবার) থেকে পুরোদমে শুরু করা হবে দেবী-প্রতিমা নির্মাণের কাজ। শুক্রবার বিকেলে বাড়ির পুরুষ-মহিলারা সারিবদ্ধভাবে কংসাবতী নদীতে গিয়ে, নদীতে প্রথম নিরঞ্জন হওয়া এক বনেদি পরিবারের দুর্গা প্রতিমা’র মাটি নিয়ে আসেন নিয়ম ও রীতি মেনে। এরপর, সমস্ত আচার-সংস্কার পালনের মধ্য দিয়ে এবং ২৭০ বছরের প্রথা মেনে জগদ্বাত্রী’র কাঠামোতে মাটি ছুঁইয়ে মূর্তি গড়া’র সূচনা করা হল।

thebengalpost.net
কংসাবতী নদী থেকে মাটি তোলার সময় :

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আরামবাগের তৎকালীন জমিদার দ্বারিকানাথ ঘোষ কর্মসূত্রে মেদিনীপুরে আসেন। এখানে আসার পর শহরের উপকণ্ঠে কঙ্কাবতী সহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক জমি কিনে ফের জমিদারি শুরু করেন। তিনি স্থির করেন, মেদিনীপুরেও দুর্গা পূজা’র সূচনা করবেন। কিন্তু, আরামবাগে যেহেতু পূজা হয়, তাই একই পরিবারের দ্বিতীয় দুর্গা পূজা করা শোভনীয় নয় বা সংস্কারের পরিপন্থী বলে মত দেন পারিবারিক পুরোহিত। তবে, তিনি ‘দশভুজা’র পরিবর্তে, সিংহবাহিনী ‘চতুর্ভজা’ জগদ্বাত্রী পূজা করতে পারেন বলেও মত দেওয়া হয়। সেই থেকে (আনুমানিক ১৭৫২-‘৫৩ খ্রিস্টাব্দে) জগদ্বাত্রী পূজা’র সূচনা হয়, মেদিনীপুর শহরের মীরবাজারের ঘোষবাড়িতে। বর্তমানে, তাঁর বংশধররা এই পুজো করছেন। এবার, পুজোর দায়িত্বে প্রয়াত শুভেন্দু শেখর ঘোষের দুই ছেলে ছেলে অজয় ঘোষ ও অশোক ঘোষ। পুজো ঘিরে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদেরও উৎসাহ-উন্মাদনা তুঙ্গে। এবার, জগদ্বাত্রী পুজো হবে ১৩ নভেম্বর নবমী তিথিতে। তার একমাস আগে থেকেই পুজো’র আবাহন পর্বের সূচনা ঘিরে মেতে উঠেছেন তাঁরা। অজয় বাবু জানিয়েছেন, “আমাদের পুজো হয় নবমী তিথিতে। তার আগে, মাটি দেওয়ার প্রথাটি পালিত হয়, মা দুর্গা’র বিসর্জনের দিন। নিয়ম আছে, নদীতে প্রথম নিরঞ্জন হওয়া যেকোনো পরিবারের দুর্গা মূর্তি থেকেই মাটি নিতে হবে, সর্বজনীন বা বারোয়ারী পুজোর মাটি নিলে হবেনা। এবার মাটি নেওয়া হয়েছে, বড়ালদের বাড়ির দুর্গা প্রতিমা থেকে।” তিনি এও জানিয়েছেন, “পুজোয় ছাগ বলি দেওয়ার রীতি আছে। পুজোর সবথেকে বড় বিশেষত্ব হল, আমাদের এই পুজোয় যত ধূপকাঠি লাগে, তা আমাদের বাড়ির গৃহবধূরাই তৈরি করেন। সঙ্গে, পুরোহিতের সহ যে সমস্ত শাড়ি প্রয়োজন হয়, তাও রাঙান (রঙ করা) আমাদের বাড়ির মেয়েরাই।” শুক্রবার বাবা অজয় ঘোষের সঙ্গে কংসাবতী নদী থেকে মাটি তুলে নিয়ে আসেন ছেলে অভিষেকও। নতুন প্রজন্মের অভিষেক-অদিতিরা বললেন, “আমরা যে যেখানেই পড়াশোনার সূত্রে বা কর্মসূত্রে থাকি না কেন, পুজোর সময় আসবোই! এমনকি, এই মাটি দেওয়ার দিনেও আমরা সকলে থেকে, আচার ও প্রথা মেনে দিনটি পালন করি।”

thebengalpost.net
মাটি দেওয়ার আচার পালিত হচ্ছে :