মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৪ মে: সরকারি শংসাপত্র বলছে, ১০০ শতাংশ দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী! বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও মানছেন, “পুরোপুরি ১০০ শতাংশ না হলেও, ৯০ শতাংশের কাছাকাছি তো হবেই। জন্ম থেকেই রেটিনার সমস্যা। ক্লাসে রিডিং পড়তে পারতো না। আমরা পড়ে দিতাম। সেটাই মন দিয়ে শুনে মনে রাখার চেষ্টা করত! এতোটাই মেধাবী ছিল যে, পরের দিন ওই পড়া যখন আমরা জিজ্ঞেস করতাম, সবথেকে ভালো উত্তর পেতাম প্রেমজিৎ এর কাছ থেকেই!” পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গল অধ্যুষিত শালবনী ব্লকের পিড়াকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র প্রেমজিৎ সাউ। দু’চোখে ‘আঁধার’ নিয়েও ‘আলোকিত’ করল স্কুলকে! এবারের মাধ্যমিকে (২ মে ফলাফল প্রকাশিত) ৭০০-র মধ্যে ৬০১ নম্বর পেয়েছে প্রেমজিৎ। প্রায় ৮৬ (৮৫.৮৬ শতাংশ) শতাংশ নম্বর। নম্বরের বিচারে বিদ্যালয়ে ‘চতুর্থ’ হয়েছে প্রেমজিৎ। যদিও, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতে, নম্বরের বিচারে ‘চতুর্থ’ হলেও, প্রেমজিৎ-ই আসল ‘চ্যাম্পিয়ন’!

thebengalpost.net
বাবার সঙ্গে প্রেমজিৎ :

শুক্রবার বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অতনু মণ্ডল বলেন, “এবারের মাধ্যমিকে আমাদের স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর হয়েছে ৬২২ (শ্রেতা সরকার)। এরপর, আরও দু’জন আছে- শুভাশীষ মাহাত (৬০৯) এবং অপূর্ব পাত্র (৬০৮)। তারপরই প্রেমজিৎ (৬০১)। তবে, ওর এই সাফল্য বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা। অনেক বেশি উজ্জ্বল! আমরা গর্বিত প্রেমজিতের মতো ছাত্র পেয়ে।” বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা জয়তী দে, সুপর্ণা ব্যানার্জি প্রমুখ বলেন, “এরকম মেধাবী, বিনয়ী, মনোযোগী আর লড়াকু ছেলে আমরা খুব কমই দেখেছি। মনের ইচ্ছেশক্তি অসীম! দিনের বেলাতেও রিডিং পড়তে পারতোনা। শুধু মন দিয়ে শুনত। অঙ্কের জন্য সরকারিভাবে বড় হরফের বইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুধু প্রেমজিৎ নয়, ওর ভাই দেবপ্রিয়ও জন্ম থেকেই প্রায় একশো শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার স্বীকার। ও নবম শ্রেণীতে পড়ে। দাদার মতোই দেবপ্রিয়ও মেধাবী। দুই ভাই-ই অত্যন্ত ভদ্র। শুধুমাত্র নিজেদের জেদ আর অধ্যাবসায়ের জোরে ওরা এগিয়ে চলেছে।” একজনও গৃহ শিক্ষক ছাড়া প্রেমজিৎ মাধ্যমিকে নম্বর পেয়েছে যথাক্রমে- 87 (বাংলা), 83 (ইংরেজি), 93 (গণিত), 82 (পদার্থ বিজ্ঞান), 86 (জীবন বিজ্ঞান), 80 (ইতিহাস) এবং 90 (ভূগোল)। বিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষিকারা মনে করিয়ে দেন, দুই ভাইয়েরই জন্ম থেকে চোখের সমস্যা। আর্থিক অভাবে সঠিক চিকিৎসাও করানো সম্ভব হয়নি। মা-কে হারিয়েছে বছর সাতেক আগে। বাবা ভিক্ষা করে কোন মতে সংসার চালান। অতিমারীর সময় দুই ভাইও বাবার সঙ্গে ভিক্ষে করতে বেরিয়েছে! জন্ম থেকে তাই শুধু দু’চোখে নয়, প্রেমজিৎ আর দেবপ্রিয়-র জীবন-জুড়েই কেবল ‘আঁধার’!

বৃহস্পতিবার (২ মে) মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর অবশ্য ‘আঁধার’ জীবনে কিছুটা খুশির ‘আলো’ প্রবেশ করেছে এক চিলতে ভাঙা ঘরে! ছেলের সাফল্যে খুশি বাবা সন্দীপ সাউ। ‘গর্বিত’ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সহ একদা মাও-অধ্যুষিত পিড়াকাটার বাসিন্দারাও। প্রেমজিৎ-দের বাড়ি যদিও ঠিক পিড়াকাটা নয়, পিড়াকাটা সংলগ্ন (দেড়-দু কিলোমিটার দূরে) মালিদা গ্রামে। একটা সময় ছিল, ঝিটাবেড়া দেওয়া এক চিলতে ঘরটুকুও ছিল না! দুই ভাই স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দাতে শুয়ে দিন (রাতও) কাটিয়েছে। এখনও অবশ্য বর্ষার দিনগুলোতে তেমনভাবেই রাত কাটাতে হয়। বছর সাতেক আগে রান্না করার সময় শাড়িতে উনুনের আগুন লেগে (অগ্নিদগ্ধ হয়ে) প্রাণ হারান প্রেমজিৎ আর দেবপ্রিয়র মা ববিতা সাউ। তবে, কোন বাধাই দুই ভাইকে তাদের লক্ষ্য আর আদর্শ থেকে দূরে সরাতে পারেনি! প্রেমজিৎ শুনেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ‘একশো শতাংশ দৃষ্টিহীন’ অতিরিক্ত জেলাশাসক IAS কেম্পা হোন্নাইয়ার কথা। প্রেমজিৎ-ও চায় WBCS অফিসার হতে! কিন্তু, তার আগে যে প্রতি পদক্ষেপে বাধা, তাও মনে করিয়ে দেয় সে। বলে, “এমন অবস্থা হয়েছিল, মাধ্যমিক পরীক্ষা যে দিতে যেতে পারবো, সেই নিশ্চয়তাও ছিলোনা!” এরপর সে নিজেই নম্বর জোগাড় করে যোগাযোগ করে পশ্চিম মেদিনীপুরের RTO সন্দীপ সাহা, পর্ষদের জেলা মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক শুভেন্দু গুইন এবং বিশিষ্ট সমাজসেবী তথা সিএবি-র জেলা প্রতিনিধি সুজয় হাজরা-র সঙ্গে। তাঁদের উদ্যোগেই গাড়িতে করে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার ব্যবস্থা হয় স্থানীয় কলসিভাঙ্গা হাই স্কুলে। সুজয়, শুভেন্দু-দের সহায়তাতেই পিড়াকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ে কলা বিভাগে (একাদশ শ্রেণিতে) ভর্তি হয়েছে প্রেমজিৎ। ভবিষ্যতেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন জেলার বিশিষ্ট সমাজসেবী সুজয় হাজরা। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অতনু মণ্ডল থেকে শুরু করে অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও বলেন, “ওদের দু’ভাইকে কখনও বইপত্র কিনতে হয়নি। আমরাই সাহায্য করেছি। ভবিষ্যতেও করব। তবুও, আমরা চাই প্রশাসনের তরফেও প্রেমজিতের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হোক। যাতে ও (এবং ওর ভাইও) আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে!” (প্রেমজিৎ সাউ-এর সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর- 95476 65498।)

thebengalpost.net
ভাঙা ঘরের সামনে প্রেমজিৎ সাউ: