দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, কলকাতা, ৩ জানুয়ারি: অযোগ্য হয়েও চাকরি পেয়েছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারী’র কন্যা অঙ্কিতা অধিকারী। কোনো তালিকাতেই নাম ছিলোনা তাঁর। কারণ, লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ইন্টারভিউ দেওয়ার মতো নম্বরই ছিল না তাঁর! দুর্নীতি করে চাকরি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক রায়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল অঙ্কিতা’কে! আর, যাঁর করা মামলার ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি, তিনি শিলিগুড়ির বাসিন্দা ববিতা সরকার। তাঁর দাবি ছিল, তিনি ওয়েটিং লিস্টে (অপেক্ষমান মেধাতালিকায়) ২০ নম্বরে ছিলেন। ১৯ জন আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন, তাই চাকরিটা তাঁর-ই প্রাপ্য। ‘বাইরে থেকে’ তালিকায় ঢুকে যাওয়া অঙ্কিতা অধিকারীকে বাদ দিয়ে, ববিতা নিজের ‘প্রাপ্য’ চাকরি চেয়েই কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের কাগজপত্র বা নথিপত্র খতিয়ে দেখে, অঙ্কিতা’কে বরখাস্ত করে, সেই ‘চাকরি’ ববিতা’ক দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে অঙ্কিতা অধিকারীর পাওয়া প্রায় ৪৩ মাসের বেতনও ববিতার হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায় মেনে সবটাই হয়েছিল। ২০২২ সালের ৪ জুলাই কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জের ইন্দিরা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন ববিতা। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। সম্প্রতি, সেই আদালতের নির্দেশেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের তরফে চাকরি পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম (Application Form) সামনে এসেছে। তাতেই দেখা গেছে ববিতা’র চাকরিতেও গন্ডগোল! অবশ্য সেজন্য ববিতা সরকার নয়, দায়ী স্কুল সার্ভিস কমিশনই!
স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে ববিতা সরকারের যে অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ‘অ্যাকাডেমিক স্কোর’ হিসেবে ববিতা’কে ‘৩৫’ এর মধ্যে ‘৩৩’ দেওয়া হয়েছে। আদতে তিনি ‘৩১’ পাওয়ার যোগ্য। স্নাতক স্তরে ‘৮০০’র মধ্যে ‘৪৪০’ অর্থাৎ ৬০ শতাংশের নিচে, কিন্তু ৪৫ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছেন ববিতা। সেই হিসেবে ‘১০’ এ ‘১০’ নয়, তাঁর ৮ পাওয়ার কথা। কিন্তু, স্কুল সার্ভিস কমিশনের সার্ভারে ববিতার নম্বর ৬০ শতাংশের বেশি হিসেব করে ‘১০’ এ ‘১০’ দেওয়া হয়েছে। আর, এতেই তাঁর (ববিতার) অ্যাকাডেমি স্কোর ‘৩১’ (মাধ্যমিক ৫, উচ্চ মাধ্যমিক ৫, স্নাতক ৮, স্নাতকোত্তর ৮, বি.এড ৫) এর পরিবর্তে ‘৩৩’ (মাধ্যমিক ৫, উচ্চ মাধ্যমিক ৫, স্নাতক ১০, স্নাতকোত্তর ৮, বি.এড ৫) হয়ে যায়! আর, ববিতার র্যাঙ্ক (Rank) স্কুল সার্ভিস কমিশনের মেধাতালিকায় বেশ অনেকটাই এগিয়ে চলে আসে। ববিতার নম্বর ‘২’ কমলে তাঁর ওয়েটিং লিস্টের র্যাঙ্ক (Rank)ও ‘২০’ থাকছেনা, বরং ‘৩০’ বা তার নিচে চলে যাওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে তালিকায় ‘২১’ নম্বরে থাকা শিলিগুড়িরই আরেক গৃহবধূ অনামিকা রায়ের র্যাঙ্ক (Rank) হবে ‘২০’। আর, অঙ্কিতা অধিকারীর ‘চাকরি এবং বেতন’ও ববিতার পরিবর্তে তাঁর-ই পাওয়ার কথা। এই ভুল সামনে আসার পর-ই অবশ্য, গতকাল অর্থাৎ সোমবার (২ জানুয়ারি) কোর্ট খুলতেই ববিতা সরকার নিজেই তাঁর আইনজীবী মারফত বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছেন। তাঁকে নতুন করে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। অন্যদিকে, চাকরির ‘দাবি’ করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন অনামিকা রায়-ও। তাঁর মামলাও গ্রাহ্য হয়েছে। আগামীকাল অর্থাৎ বুধবার মামলার শুনানি হওয়ার কথা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের। আর, এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষা জগতের তরফে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে। একপক্ষের দাবি, “সব জেনেও এতদিন কেন চুপ ছিলেন ববিতা? তিনি নিজে তো জানতেন তাঁর অ্যাকাডেমিক স্কোর!” অপরপক্ষের দাবি, “স্কুল সার্ভিস কমিশনের ভুল। ববিতার কোনো দোষ নেই!” ববিতা ও তাঁর আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের বক্তব্য, স্কুল সার্ভিস কমিশনের তরফে এই হিসেব করা হয়েছিল। অ্যাকাডেমিক স্কোরে ‘ভুল’ বুঝতে পারার পরই তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন! ববিতার এই পদক্ষেপ সম্পর্কে সিনিয়র আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, “ববিতার এই পদক্ষেপে সমাজে সঠিক বার্তা পৌঁছবে।”