দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩ মে:প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে তালপাতার হাত পাখা। বাঁশ কিংবা বেতের তৈরি ঝুড়ি, কুলো, পালি, মোড়া, ফুলদানি- প্রভৃতিও ক্রমেই অচল হয়ে যেতে বসেছে আধুনিকোত্তর সমাজব্যবস্থায়। আর সেজন্যই, এই সমস্ত জিনিসপত্র তৈরি করে বা বিক্রি করে যাঁরা সংসার চালাতেন, তাঁরাও এখন নিজেদের পেশা বদলে নিচ্ছেন। অথচ, দু’দিন আগেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই সমস্ত প্রাকৃতিক জিনিসপত্র বা হস্তশিল্পের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম! ধীরে ধীরে তা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে, এই সমস্ত সজীব ও শৈল্পিক জিনিসপত্রের চাহিদা যে একেবারে নেই, তা নয়! বরং, সঠিকভাবে তা পৌঁছে দিতে পারলে, গ্রাম বাংলা ছাড়িয়ে শহর-বাজারের মানুষও তা সাদরে গ্রহণ করতে পারেন। আর, সেই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিও অনেকখানি সচল হতে পারে। সর্বোপরি, অনেকেই এখন পেশা বদলে ফেলতে বাধ্য হলেও, নিজেদের শিল্পীসত্ত্বাকে বিসর্জন দিতে পারেননি! তাই, এখনও কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় তাঁরা তৈরি করে চলেছেন ঝুড়ি, কুলো, পালি, মোড়া কিংবা হাত পাখার মতো বাঁশ কিংবা বেত বা আটাংলতার তৈরি জিনিসপত্র। আর, এই ভাবনা থেকেই মেদিনীপুর শহরের রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয় (স্বশাসিত) অর্থাৎ গোপ কলেজ তিনদিন ব্যাপী একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল, মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাঁদড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বেলিয়া গ্রামের ভুঁইয়াহাতা পাড়ায়। আর, এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভুঁইয়াহাতা পাড়ার ৬০-টি পরিবারের মহিলারা। রাজ্য সরকারের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগের সহায়তায় এবং আইআইটি খড়্গপুরের (IIT Kharagpur) সক্রিয় সহযোগিতায় এই কর্মশালা পরিচালিত হল মহিলা মহাবিদ্যালয়ের উদ্যোগে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গ্রামবাংলায় বাঁশ ও আটাংলতার তৈরি সামগ্রীর চাহিদা আছে। গরমের দিনে হাতপাখার কদরও রয়েছে। তা ছাড়াও, বিভিন্ন পুজোর কাজে লাগে ঝুড়ি, সাজির মতো সামগ্রী। তাই, বাঁশ ও শাল জঙ্গলের আটাংলতা দিয়ে হস্তশিল্পের কর্মশালা শুরু হল। বনজ সম্পদ থেকে কিভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করা হবে, তা থেকে কিভাবে সৌখিন দ্রব্যাদি তৈরি করা হবে এবং বাজারজাত করা হবে, সেই বিষয়ে আলোচনা হয়। বিশেষত, জোর দেওয়া হয়েছে গ্রামবাংলার হস্তশিল্পের আধুনিকীকরণ, প্রচাল ও বাজারজাত করার উপর। মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলা এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যেই এই প্রয়াস বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, যাঁরা সারা বছর বাঁশের নানা সামগ্রী তৈরি করে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম করুনা কালিন্দী নামে এক জন জানান, “বছরভর বিভিন্ন পুজোর জন্য ঝুড়ি, কুলো, ফুলের সাজির চাহিদা থাকে। আগে গ্রামে অনেক মহাজন এসে বরাত দিয়ে যেত। এখন চাহিদা কমেছে প্লাস্টিকের ব্যবহারে।”
মূলত, মেদিনীপুর সদরের এনায়েতপুর, মেদিনীপুর, ধেড়ুয়ার মতো বাজারে তাঁরা সেই সব জিনিস বিক্রি করতে যান। ওই গ্রামের সঞ্জয় কালন্দী বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পেশা ছেড়ে বেশিরভাগই দিনমজুরি করছেন। কিন্তু, আমরা এই কাজের উপরেই সাধারণত নির্ভরশীল। তাই অন্য কাজের ফাঁকে কিছু বাঁশ ও আটাং এর জিনিস তৈরি করে রাখছি। যদি বিক্রি হয়!” রাজ নরেন্দ্র লাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক প্রভাত কুমার শীট বলেন, “বাঁশ ও আটাংলতা পরিবেশ বান্ধব, সৌভাগ্যের প্রতীক। যা ব্যবহারে দূষন কমে এবং গ্রামীণ আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। গ্রামবাসীদের দাবি, তাঁরা হাতের কাজ করেই সংসারের হাল ফেরাতে চান। যদি সরকার সাহায্যে এগিয়ে আসে তো ভাল হয়। এদিনের, এই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন চাঁড়দা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ভবানী দে, গবেষক অমর্ত্য পাণী (আইআইটি খড়্গপুর), গবেষক মৃতুঞ্জয় জানা (নর্থ ওড়িশা বিশ্ববিদ্যালয়), গবেষক নিত্যানন্দ সর (নর্থ ইস্টার্ন হিল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রমুখ।