দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২০ ফেব্রুয়ারি: মেয়েটার নাম ‘অভাগী’ দেওয়া যেতেই পারে! দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। তার উপরে আবার কন্যাসন্তান! তার পর আরও এক বোন! তার পর অবশ্য বাবা-মা’র কোল আলো করে এসেছে ‘পুত্র’ সন্তান! তাই, ছোট থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করলেও, মেয়েটাকে তার বাবা সহ পরিবারের সদস্যরা ‘বোঝা’-ই ভাবতেন। স্বাভাবিকভাবেই মাধ্যমিক দেওয়ার সাথে সাথেই বছর ১৬-র (১৬ বছর ৮ মাস) বিয়ে ঠিক করে ফেলে পরিবার। অভাগী কিন্তু আরও পড়তে চেয়েছিল! বাবা-মা’র হাত ধরে কাতরভাবে জানিয়েছিল, “আমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট ভালো হবে। আমি আরও পড়তে চাই।” কে শোনে কার কথা! অগ্যতা গাঁয়ের মেয়ে অভাগী-র (নাম নেহাতই কাল্পনিক) আজ, মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি)-ই বিয়ে ঠিক করা হয়। চোখে জল, আর হৃদয়ে ‘আগুন’ নিয়ে এবার নিজের বিয়ে রুখতে বদ্ধপরিকর হয় সে। বিদ্যালয়েরই কন্যাশ্রী ক্লাবের ছাত্রীদের কাছ থেকে নম্বর জোগাড় করে মঙ্গলবার সকালেই ফোন করে সরাসরি প্রধান শিক্ষককে। আর তাতেই কেল্লাফতে!
ঘটনাটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী ব্লকের বেনাচাপড়া নামে প্রত্যন্ত একটি গ্রামের। চলতি বছরই শালবনী ব্লকের নান্দাড়িয়া শাস্ত্রী স্মৃতি বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিক দিয়েছিল সে। আর তারপরই বাড়ির লোকজন ছাত্রীর অমতেই বিয়ে ঠিক করে ফেলে। বরাবর ভাল রেজাল্ট করা নাবালিকা ছাত্রীর কোনও অনুনয়-বিনয়েই আমল দেননি তার মদ্যপ বাবা সহ পরিবারের লোকজন। আজ (মঙ্গলবার) রাতেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল! এরপরই বাধ্য হয়ে ওই ছাত্রী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শুদ্ধদেব চ্যাটার্জির ফোন নম্বর জোগাড় করে মঙ্গলবার সকাল ৯-টা নাগাদ তাঁকে ফোন করে। কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, “স্যার আমি…। আমি আরও পড়তে চাই। কিছু একটা ব্যবস্থা করুন!” মেদিনীপুর শহর থেকে বিদ্যালয়ে পৌঁছেই শুদ্ধদেব বাবু ব্লক প্রশাসন এবং শালবনী থানায় বিষয়টি জানান। শুধু তাই নয়, দু’টি গাড়িতে করে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কন্যাশ্রী ক্লাবের ছাত্রীদের নিয়ে পৌঁছে যান বেনাচাপড়া গ্রামে। পৌঁছন শালবনী থানার পুলিশ আধিকারিকরাও। সকলের সমবেত লড়াইয়ে রুখে দেওয়া হয় অভাগী-র বিয়ে!
এদিকে, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানতে পারেন, যে পাত্রের সাথে অভাগীর বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল সেও তাঁদের স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। বছর ২২-র ওই যুবককেও ফোন করে বোঝান শিক্ষক-শিক্ষিকারা। রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী, রূপশ্রী সহ বিভিন্ন প্রকল্পের কথাও তুলে ধরা হয়। যুবক জানান, তিনি জানতেন না পাত্রীর বয়স এখনও ১৮ হয়নি! সব শুনে বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন ওই যুবক। মুচলেকা দিয়ে এ যাত্রায় রক্ষা পান অভাগী’র বাবা-মাও। অন্যদিকে, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা সিদ্ধান্ত নেন, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অভাগীর পড়াশোনার সমস্ত খরচ তাঁরাই চালাবেন! শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলেন, “কন্যাসন্তান মানে বোঝা নয়। শুধু এই পরিবারকেই নয়, সমগ্র সমাজকেই আমরা এই বার্তাটা দিতে চাই। সকাল থেকে একনাগাড়ে কেঁদে চলা মেয়েটা এবার একটু হাসে! জড়িয়ে ধরে বিদ্যালয়ের কন্যাশ্রী ক্লাবের ছাত্রীদের। চোখে অবশ্য তখনও জল। প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলেন, “ওটা ওর আনন্দাশ্রু!”