দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ সেপ্টেম্বর: ‘অভিষেক-লবি’র জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা-র বিরুদ্ধে দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নানা ‘অনুযোগ’ বা ‘অভিযোগ’ করলেন তাঁর (মুখ্যমন্ত্রীর) ঘনিষ্ঠ বিধায়কেরা। বৃহস্পতিবার বিধানসভার অধিবেশন শেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে গিয়ে দলের মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি সুজয় হাজরা-র বিরুদ্ধে পশ্চিম মেদিনীপুরের ৯ জন তৃণমূল বিধায়ক ‘অনুযোগ’ করেছেন বলে সূত্রের খবর। এই বিধায়কদের প্রায় সকলেই দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের আহ্বায়ক (কো-অর্ডিনেটর) অজিত মাইতি ঘনিষ্ঠ বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বলাই বাহুল্য মূলত অজিত মাইতির নেতৃত্বেই এদিন বিধায়করা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ‘বিশেষ’ সাক্ষাৎ করে সুজয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান বলে সূত্রের খবর। সেই তালিকায় আছেন দাঁতনের বর্ষীয়ান বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধান, গড়বেতার বিধায়ক উত্তরা সিংহ হাজরা, নারায়ণগড়ের বিধায়ক সূর্যকান্ত অট্ট, মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়া সহ বেশ কয়েকজন। এমনকি সুজয়-ঘনিষ্ঠ হিসেবে জেলায় পরিচিত, খড়্গপুর গ্রামীণের বিধায়ক দীনেন রায়-ও নাকি সেই দলে ছিলেন। সুজয়ের বিরুদ্ধে তাঁরা মূলত দলে ‘গোষ্ঠী-রাজনীতি’ চালানোর অভিযোগ করেছেন বলে জানা যায়।
শুধু সুজয় নন, এই সমস্ত বিধায়কদের অনেকেই জেলার পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকারের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ করেছেন বলে কলকাতার একটি সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। তবে, এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ অবশ্য মুখ খোলেননি। বিষয়টি সামনে আসার পরই, এই বিষয়ে একাধিকবার দলের বর্ষীয়ান বিধায়ক অজিত মাইতি, দীনেন রায়দের ফোন করা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি। জানা যায়, বৃহস্পতিবার বিধানসভার অধিবেশন শেষে অজিত মাইতি, বিক্রম চন্দ্র প্রধান, দীনেন রায়, সূর্য অট্ট, উত্তরা সিংহ হাজরা, অরূপ ধাড়া, মমতা ভুঁইয়া, জুন মালিয়া, মন্ত্রী শিউলি সাহা-রা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরাই দলের মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা-র বিরুদ্ধে একাধিক বিষয়ে অভিযোগ জানান। সুজয় এবং জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার নাকি বিধায়কদের বিরুদ্ধে দলের ব্লক সভাপতি এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিদের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছেন! দাঁতনের বর্ষীয়ান বিধায়ক বিক্রম চন্দ্র প্রধানও নাকি তাঁর এলাকায় ‘গোষ্টিবাজি’র জন্য দলের জেলা সভাপতি-কে দায়ী করেছেন। তবে, শিউলি সহ ঘাটাল সাংগঠনিক জেলার বিধায়কদের অভিযোগ নাকি ছিল জেলা পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে! শিউলি নাকি তাঁকে কেশপুরে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে দিদি’র কাছে ‘অনুযোগ’ করেন। তাঁদের অভিযোগ পাওয়ার পরই নাকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার-কে ফোনে জানান, “সুজয়ের কথা শুনে চলবার দরকার নেই। বিধায়কদের কথা শুনে চলতে হবে। ওদের নিয়ে বৈঠক করতে হবে। ওরা আমার দলের সম্পদ। ওদের মধ্যে অনেকেই প্রথম থেকে আমার সঙ্গে ছিল। আমি সুজয়কে পদ থেকে সরিয়ে দেবো। ওর কথা শোনার দরকার নেই।” সেই সময় মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে উপস্থিত বিধায়কদের একাংশ এবং কলকাতার সাংবাদিকদের অনেকেই নাকি পরস্পরের দিকে ‘মুখ-চাওয়াচাওয়ি’ করেন!
এই বিধায়কদের দলে সবংয়ের বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্যাবিনেট মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভুঁইয়া, শালবনীর বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাত, কেশিয়াড়ির বিধায়ক পরেশ মুর্মু, ডেবরার বিধায়ক হুমায়ুন কবীর ছিলেন না বলেই জানা যায়। তাঁরা অবশ্য পৃথকভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। শ্রীকান্ত, পরেশরা সুজয়-কেই জেলা সভাপতি হিসেবে চান বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন। তবে, দলের মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান তথা খড়্গপুর গ্রামীণের বিধায়ক দীনেন রায় সুজয়-ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অজিতদের সঙ্গে অভিযোগ জানাতে যাওয়ায় জেলা তৃণমূলের একটা বড় অংশ বেশ অবাক হয়েছেন! যদিও, দীনেন রায় ফোন ধরেননি, তবে দীনেন তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে নাকি জানিয়েছেন, সুজয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হবে বলে তিনি নাকি জানতেন না! তবে, দলের অন্য একটি অংশের মত, “দীনেন দা-ই হয়তো জেলা সভাপতি হতে চাইছেন!” এদিন দলের বিধায়কদের কাছে খড়্গপুরের সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচী-র গ্রেপ্তার হওয়া নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী খোঁজ নিয়েছেন বলে জানা যায়। এই বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপারকে ফোন করে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা যায়। এদিন এই বিষয়ে প্রেসক্লাব, কলকাতার পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে জানানোর পরই নাকি তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। এই পুরো বিষয় নিয়ে দলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা জানান, “যেদিন থেকে দায়িত্ব নিয়েছি, দলের নির্দেশের বাইরে গিয়ে একটি কাজও করিনি। স্বচ্ছভাবে দল চালানোর চেষ্টা করেছি। পৌরসভা, পঞ্চায়েত নির্বাচনে দল সাফল্য পেয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেকের হয়তো ‘অসুবিধা’ হচ্ছে! যদিও, আমার কাছে দলের তরফে কোন নির্দেশ বা কোন রকম ফোন আসেনি। তবে, পদের জন্য আমি কোনদিনই লালায়িত নই!” জেলার এক সাংবাদিকের গ্রেফতার হওয়া নিয়েও দুঃখপ্রকাশ করেছেন শাসকদলের জেলা সভাপতি। অন্যদিকে, এই বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে জেলা বিজেপির মুখপাত্র অরূপ দাস বলেছেন, “এটা তো কোন রাজনৈতিক দলই নয়, আমরা তো বলি সার্কাস দল। আর, এই দলে ‘খাওয়াখায়ি’-র সমস্যা হলেই এ ওর পেছনে কাঠি করে!”