দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৯ মে:চাকরি দেওয়ার নাম করে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা বিধানসভার বিধায়ক তথা রাজ্যের কারিগরী শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীর তাঁকে কলকাতায় ডেকে পাঠান। কিন্তু, কাজ দেওয়ার বদলে আড়াই মাস ধরে পরিচারিকার কাজ করানো হয়েছে! এমনই মারাত্মক অভিযোগ করেছিলেন, ডেবরার ব্রাহ্মণশ্মশান গ্রামের আদিবাসী তরুণী সবিতা লায়েক। অভিযোগকারিণী সবিতা লায়েকের কথায়, “উনি আমাকে অফিসের মুখ দেখাননি, কিছুই করেননি! বাড়িতেই আমাকে ঝি-চাকরের কাজ করিয়েছেন। বাড়ির সমস্ত কাজ। ঘর মোছা থেকে বাথরুম পরিষ্কার থেকে কুকুরের দেখাশোনা। ওনার মেয়ের জন্যও কাজ করিয়েছেন।” এই ‘চাকরি’ দেওয়ার জন্যই মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর তাঁর কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ তরুণীর। অভিযোগকারিণীর কথায়, “কাজের সূত্রে ওঁরা ৫ লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন। আমি তা দিতে পারিনি। আমার বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। উনি ঘর করার জন্য টাকা রেখেছিলেন, ২ লাখ টাকা মতো। ওই টাকাই দিয়েছিলাম।” এরপর, কাজ তো দেওয়া তো দূরের কথা, তার পরিবর্তে জুটেছিল পরিচারিকার কাজ, আর সঙ্গে ‘কটুক্তি’! সবিতা জানান, “একদিন উনি বোতাম সেলাই করতে বলেন। আমি বলি, আমি এটা জানি না। উনি একজন মন্ত্রী হয়ে বললেন, তুই কি রাজার বাড়ি থেকে এসেছিস নাকি? আদিবাসী ছোট জাত। জঙ্গলে থাকা লোক। এ কী চাকরি করবে! এর জঙ্গলে থাকা দরকার। ওনার স্ত্রীও আমাকে গালাগালি করেছেন। তারপর বলেছেন, এখানে তোর কোনও আশ্রয় নেই। তারপরের দিন ঘাড় ধাক্কা মেরে বের করে দিয়েছেন ওনার বাড়ি থেকে।” এরপরই, কলকাতায় FIR দায়ের থেকে শুরু করে, মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর ও জেলা পুলিশে অভিযোগ জানান সবিতা। তারপরই রাজ্য জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়! বিতর্কের মুখে তাই অভিযোগ প্রত্যাহার করতে ডেবরার ওই আদিবাসী তরুণীর উপর চাপ সৃষ্টি ও তাঁকে হেনস্থার অভিযোগ উঠল মন্ত্রী-পত্নীর বিরুদ্ধে। ঘটনায় স্থানীয় একাধিক তৃণমূল নেতা, এমনকি পুলিশও জড়িত বলে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারকে অভিযোগ জানিয়েছেন সবিতা লায়েক নামে ওই তরুণী।

thebengalpost.net
বিতর্কে মন্ত্রী :

মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এনিয়ে, গত শনিবার (৭ মে) মেদিনীপুর শহরে দলীয় বৈঠক শেষে হুমায়ুন জানিয়েছিলেন, “মিথ্যে অভিযোগ করা হচ্ছে। বিজেপি প্রোপাগোন্ডা তৈরি করেছে। ওকে দিয়ে কোনও কাজ করানো হয়নি। আমার বাড়িতে প্রতিটি কাজের জন্য, আলাদা আলাদা কাজের লোক আছে। মেয়েটি অ্যাটেন্ডেন্টের কাজ করত। চিঠিপত্র নেওয়া, নাম লিখে রাখা এইসব কাজ। তারপর ভালো লাগেনি বলে নিজেই কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। শীঘ্রই কাজে যোগদান করবে। সে স্বেচ্ছায় কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ওর পুলিশের কাজ করার ইচ্ছে ছিল। এখন আবার বলছে, কাজে যোগদান করবে। ও যেদিন জয়েন করবে, আমরা জয়েন কোরিয়ে দেবো। এটা একটা রাজনৈতিক চক্রান্ত। বিজেপি এর মধ্যে রয়েছে। ওর কিছু এভিডেন্স আছে আমার কাছে, যেগুলো দেখালে এক মিনিটের মধ্যে বুঝতে পারবেন এটা মিথ্যে অভিযোগ।” এদিকে, সেই ‘মিথ্যে অভিযোগ’ প্রত্যাহার করতেই নাকি হুমায়ুন কবীরের স্ত্রী অনিন্দিতা দাস কবীর এবং স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা তাঁকে ভয় দেখাচ্ছেন এবং ছাপানো বয়ানে তাঁকে জোর করে সই করানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ সবিতার। ওই বয়ানে নাকি লেখা ছিল, মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে তিনি যা অভিযোগ এনেছিলেন, সে সব মিথ্যা! তবে, সবিতা শেষ পর্যন্ত সই করেননি। কিন্তু, তিনি ও তাঁর পরিবার যথেষ্ট আতঙ্কে রয়েছেন। শনিবার, ৭ মে রাতে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার দীনেশ কুমারের কাছে ই-মেলে নাকি এই বিষয়ে অভিযোগও করেছেন সবিতা। নিরাপত্তাও চেয়েছেন।

thebengalpost.net
ওই তরুণী নিজের গ্রামে:

ওই অভিযোগে সবিতার দাবি, চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা বলে ৬ মে সকালে তাঁর বাড়িতে পুলিশ আসে। পুলিশের গাড়িতেই তাঁদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে এক তৃণমূল নেতার গাড়িতে তাঁকে ও তাঁর অভিভাবকদের নিয়ে যাওয়া হয় কোলাঘাটের হোটেলে। সঙ্গে কয়েক জন নেতা ও সাধারণ পোশাকে এক পুলিশকর্মীও গিয়েছিলেন। সবিতা বলেন, “ওখানেই হুমায়ুন কবীরের স্ত্রী ও দলীয় নেতা অলোক আচার্য, প্রদীপ কর, আবু বক্স, শীর্ষেন্দু অধিকারী মিথ্যা ছাপানো বয়ানে আমাকে সই করার জন্য চাপ দেন। আমি সই না করায় আমাদের খুবই হেনস্থা করেন। কোনওক্রমে ডেবরায় ফিরি। এখনও বাড়ি এসে নেতারা চাপ দিচ্ছেন। লকআপে ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।” যদিও, এনিয়ে জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার জানিয়েছেন, “অভিযোগ তুলতে পুলিশ কখনওই চাপ দিতে পারে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” তবে, গত ৬ মে, কোলাঘাটের এক হোটেলে সবিতার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অনিন্দিতার দেখা হয়েছিল বলে মানছেন হুমায়ুন। কিন্তু, তাঁর স্ত্রী ওই হোটেলে সবিতাদের খাওয়ার বিল দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন বলে তাঁর বক্তব্য। এমনকি, স্থানীয় নেতাদের অনুরোধে সবিতাকে পুরানো কাজে (বাড়ির অফিসের অ্যাটেন্ডেন্ট) যোগদান করাতে তিনি রাজি হয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন। যদিও, সেই কাজ করতে রাজি নয় সবিতা! সবিতার অভিযোগপত্রে নাম থাকা তৃণমূল নেতা শীর্ষেন্দু অধিকারীও বলছেন, “নিয়োগপত্র দেবেন বলেই মন্ত্রী গত শুক্রবার (৬ মে) সবিতাকে কলকাতায় ডেকেছিলেন। আমার গাড়িতেই সবিতারা যায়। ডেবরা পুলিশের নিরাপত্তায় সবিতাকে নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝে কোলাঘাটে মন্ত্রীর স্ত্রী ওদের খাওয়া-দাওয়া করান। সেখানে একবার একটি কাগজে মন্ত্রীর স্ত্রী সই করতে বলেছিলেন।” পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ অলোক আচার্যের আবার দাবি, “আমি শুক্রবার কলকাতা গিয়েছিলাম। ফেরার পথে কোলাঘাটে ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়। আমিই সবিতাকে বলেছিলাম, ওই বয়ানে তুমি সই করবে কি না সেটা তোমার ব্যক্তিগত বিষয়।” এনিয়ে মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, “এটা নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে পুরোদমে। দলেরই অনেকে তো বিধানসভায় আমাকে হারানোর চেষ্টা করেছিলেন!” পুরো ঘটনাটি সম্পর্কে বিজেপির ঘাটাল সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তন্ময় দাস বলেন, “তৃণমূলের মন্ত্রী হুমায়ুন কবির নিজের দোষ ঢাকার জন্য, নিজের গায়ে যে কাদা লেগেছে সেই কাদা পরিষ্কার করার জন্য কখনও বিজেপি-কে, কখনও দলেরই অন্যদের দোষারোপ করছেন। দলিত সম্প্রদায়ের মহিলাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ির চাকরানির কাজ করিয়েছেন। বাথরুম পরিষ্কার থেকে শুরু করে জামা প্যান্ট সেলাই সবকিছু করিয়েছেন। আজকে সেই মহিলা যখন বুঝতে পেরেছেন, তাকে দিনের পর দিন ঠকানো হচ্ছে! তখন তিনি মন্ত্রীর নামে এফআইআর করেছেন।”

thebengalpost.net
মেদিনীপুরে মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের সাফাই :