দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৩ মার্চ: ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলার ছোটনাগরা এলাকায় মাওবাদী দমন অভিযানে গিয়ে, মাওবাদীদের পুঁতে রাখা আইআইডি বিস্ফোরণে ‘শহিদ’ হয়েছেন CRPF-র ১৯৩নং ব্যাটেলিয়নের সাব ইন্সপেক্টর সুনীল কুমার মণ্ডল। শহিদ জওয়ান মেদিনীমাতার বীর সন্তান। তাঁর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা-২ ব্লকের (গোয়ালতোড় থানার) গাছউপড়া গ্রামে। শনিবার (২২ মার্চ) বেলা আড়াইটা নাগাদ ছোটনাগরা সংলগ্ন মারাংপঙ্গার জঙ্গলে ভয়াবহ এই ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা নাগাদ গাছউপড়ার মণ্ডল পরিবারে ছোট ছেলের ‘শহিদ’ হওয়ার খবর এসে পৌঁছয়। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে স্ত্রী সহ পরিবারের! কেঁদেই চলেছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। আর মাত্র দু-চারদিন পরেই বাড়ি ফেরার কথা ছিল মৃত CRPF জওয়ানের। তার পরিবর্তে রবিবার রাতে ফিরলো ‘কফিনবন্দী’ দেহ!

গোয়ালতোড় থানার গাছউপড়া গ্রামের প্রবীণ ক্ষুদিরাম মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী মণ্ডলের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তিন ছেলের পর, এক মেয়ে (পূরবী)। বড় ছেলে নির্মল মণ্ডল চাষবাস করেন। তবে, মেজ ও ছেলে দু’জনই ভারতমাতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। মেজ ছেলে অমল মণ্ডল গত ৪০ বছর ধরে বিএসএফে চাকরি করছেন। আর, গত ৩৭ বছর ধরে সিআরপিএফে ছিলেন তাঁদের ছোট ছেলে সুনীল মন্ডল। বছর ৫৭-র সুনীলের আর মাত্র সাড়ে ৩ বছর চাকরি ছিল বলে জানান মেজদা অমল মণ্ডল। তিনি বলেন, “আমার রায়গঞ্জে পোস্টিং। আমার আর মাত্র দেড় বছর চাকরি আছে। ভাইয়ের পোস্টিং ছিল মাও অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডে। ওই ব্যাটেলিয়নে ওই কমান্ড্যান্ট ছিল। তাই ও সামনে ছিল। ওর সঙ্গে ছিলেন বাঁকুড়ার এক জওয়ান (পার্থপ্রতিম দে)। গত দু’তিন দিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে বুঝতে পারেনি, ল্যান্ডমাইন পোঁতা আছে। পা দিতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ! ও শহিদ হয়।” রবিবার দুপুরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বিএসএফ আধিকারিক অমলবাবু এও বলেন, “কষ্ট তো হচ্ছেই। কষ্ট-যন্ত্রণা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আমার মা আর বউমা (সুনীল বাবুর স্ত্রী)-কে তো সামলানোই যাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, আমরা গর্বিতও। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে আমার ভাই। আমরা দুই ভাইই তো দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের অর্পণ করেছিলাম সেই কৈশোর থেকে। আমার চাকরি হয়ে গেল প্রায় ৪০ বছর। ভাই প্রায় ৩৭ বছর চাকরি করল। আর মাত্র সাড়ে ৩ বছর চাকরি ছিল ওর। তার আগেই…!” চোখে জল বিএসএফ আধিকারিক অমল বাবুর। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি জানান, ভাই সুনীলের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে শিউলির বছর পাঁচেক আগেই বিয়ে হয়েছে গোয়ালতোড় থানারই একটি গ্রামে। ছেলে বসন্ত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। থাকেন গুজরাতে। গত ২৪ জানুয়ারি, ছেলের বিয়ে উপলক্ষেই শেষবারের জন্য গ্রামে এসেছিলেন সিআরফিএফ সাব ইন্সপেক্টর সুনীল। প্রায় ৮-১০ দিন সকলের সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে গিয়েছেন। চলতি মাসের ২৬-২৭ তারিখ ফের বাড়ি আসার কথা ছিল সুনীল বাবুর। তার আগেই ‘শহিদ’ হয়েছেন! বাবার জন্য ‘গর্বিত’ ছেলে বসন্তও। রবিবার বেলা ২টো নাগাদ সুদূর গুজরাত থেকে বাড়িতে পৌঁছেছেন, ‘শহিদ’ বাবার শেষকৃত্যে অংশ নেবেন বলে। বাড়িতে পৌঁছতেই নাতিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসান লক্ষ্মী দেবী। একটাই কথা বলে চলেন তিনি, “আমার গোপালটা কোথায় চলে গেল…একটিবার আমার বুকে আয় বাবা!”
গান স্যালুটে সহকর্মীকে বিদায় জানালেন ১৯৩নং ব্যাটেলিয়নের সিআরফিএফ জওয়ানরা। উপস্থিত ছিলেন সিআরফিএফ আধিকারিকরাও। গান স্যালুট দেওয়া হয় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের তরফেও। উপস্থিত ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার, গড়বেতার বিধায়ক উত্তরা সিংহ হাজরা প্রমুখ। রাত্রি ৮টা নাগাদ ‘শহিদ’ সুনীল কুমার মণ্ডলের দেহ পৌঁছয় গাছউপড়া গ্রামে। সকলের চোখে জল! সবার প্রিয়, ‘অজাতশত্রু’ সুনীলকে শেষ বিদায় জানালেন তাঁরা। গোটা গ্রামকে গর্বিত করে, একদা মাও অধ্যুষিত গাছউপড়া গ্রামের সুনীলের মৃত্যু হল সেই মাওবাদী হামলাতেই! এই রাজ্যে মাওবাদীরা নিকেশ হয়েছে, তাঁরা চাইছেন সারা দেশ থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক এই গণশত্রুরা।