মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৯ মার্চ:মেদিনীপুরের ছোট্ট রূপসা। বয়স মাত্র ৭। ২ বছর বয়স থেকেই বিরল স্নায়বিক রোগ এস.এম.এ (Spinal Muscular Atrophy)-তে আক্রান্ত। হাঁটতে চলতে পারে না, এমনকি হাত-পা গুলিও ভালো করে নাড়াতে পারেনা সে। তবে, পড়াশোনা করার অদম্য ইচ্ছে মনে। স্কুলে ভর্তির সময় হয়ে গেলেও, সাধারণ স্কুলে ভর্তি নিচ্ছিলনা ওকে। নিতান্ত সাধারণ পরিবারের বাবা-মা শেষমেশ শরণাপন্ন হন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দু বিষই-এর। তিনিই রূপসা-কে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। মেদিনীপুর টাউন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে রূপসা। সোমবার থেকে স্কুলেও যাচ্ছে সে। মনে তার খুব আনন্দ! তবে, ৭ বছরের মেয়েকে প্রতিদিন কোলে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিল বাবা-মা’র। সেই কষ্টও লাঘব করতে উদ্যোগী হলেন ডিপিএসসি (DPSC)’র চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দু বিষই। বুধবার বিকেলে রূপসা’র বাবা-মা’র হাতে তুলে দিলেন হুইল চেয়ার। বাবা-মা’র সঙ্গে সংসদ কর্যালয় বা ডিপিএসসি-তে এসেছিলেন ছোট্ট রূপসাও। বাবা সুমন মুখার্জি এবং মা সান্ত্বনা মুখার্জি’র সঙ্গে কৃষ্ণেন্দু-ও পরম যত্নে ছোট্ট রূপসা-কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিলেন। হাতে তুলে দিলেন চকলেটের বাক্স। চোখ ছলছল করে উঠল, সুমন, সান্ত্বনা এবং কৃষ্ণেন্দু সহ উপস্থিত সকলেরই! অবশ্য তারপরই ছোট্ট রূপসা’র মুখে ‘সৎপাত্র’ (সুকুমার রায়ের লেখা) আবৃত্তি শুনে চোখের জল মুছে সকলেই করতালি দিতে আর রূপসা-কে আদর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন!
প্রসঙ্গত, এই এসএমএ (SMA) বা Spinal Muscular Atrophy হল বিরল এক স্নায়বিক রোগ। জন্মগত ত্রুটি বা জেনেটিকাল ডিসঅর্ডার এর কারণে এই বিরল রোগে আক্রান্ত হয় শিশুরা। এই রোগের বিশেষ কোনো চিকিৎসা নেই। বয়সের সাথে সাথে শরীরের হাড় এবং স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়। ক্রমেই শক্তি হারাতে থাকে শরীর। ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যদিও, রূপসা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে দেড়-দু’বছর বয়স থেকে। মেদিনীপুর শহরের বল্লভপুরের বাসিন্দা রূপসা’র বাবা সুমন মুখার্জি জানান, “ওর যখন দেড়-দু’ বছর বয়স, তখন বেশ কিছু জটিল সমস্যা দেখা দেয়। আমরা কলকাতার বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. অপূর্ব ঘোষ-কে দেখাই। উনি তখন ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানেই ধরা পড়ে, রূপসা এসএমএ-তে আক্রান্ত। তারপর থেকেই এই কঠিন লড়াই চলছে।” তিনি এও জানান, “সারা ভারতবর্ষে মাত্র ২৫০-৩০০ জন শিশু এবং পশ্চিমবঙ্গে ৪০-৫০ জন শিশু এই বিরল রোগে আক্রান্ত। আগে কোনো চিকিৎসা ছিলনা। সম্প্রতি আমরা জানতে পেরেছি, এই রোগের ওষুধ ও ইনজেকশন বেরিয়েছে। তবে, খরচ বিপুল। প্রায় কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে চিকিৎসা করানোর জন্য!” সুমন মেদিনীপুর শহরের একটি নামকরা অলংকার দোকানের (জুয়েলারি শপের) কর্মচারী। তিনি এত টাকা পাবেন কোথায়! স্বামীর পাশে দাড়িয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে, রূপসা’র মা সান্ত্বনা মুখার্জি বলেন, “ও হাঁটতে চায়, অনেক পড়াশোনা করতে চায়। বলে, মা আমিও হাঁটতে চাই, খেলতে চাই, পার্কে যেতে চাই, আর স্কুলে যেতে চাই। ওর খুব বুদ্ধি। একবার কোন পড়া কিংবা আবৃত্তি শুনলেই মনে রাখতে পারে। আমার এই মেয়েটার চিকিৎসার জন্য যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি, সংস্থা বা সরকার এগিয়ে আসে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। চেয়ারম্যান স্যার ওকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। দু’দিন স্কুলে গিয়েই ওর কি আনন্দ! কৃষ্ণেন্দু স্যার ওর জন্য যা যা করলেন, সেজন্য আমরা চির ঋণী হয়ে থাকব। উনি বলেছেন ওনার সাধ্যমত পাশে থাকবেন। কিন্তু, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার এগিয়ে না এলে, এই রোগের চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়! এখন ও বসতে পারে, আগামী দিনে হয়তো তাও পারবেনা। ওকে হয়তো হারিয়ে ফেলতে হবে আমাদের!” আর, জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংসদের চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দু বিষই বললেন, “আমাদের অফিসের একজন কর্মী সৌরভ মুখার্জি, এই ঘটনাটি জানানোর পরে আমি সাধ্যমতো উদ্যোগ নিয়েছি। আমি আমার নিজের বেতন থেকেই ছোট্ট রূপসা-কে একটি হুইল চেয়ার কিনে দিয়েছি। এবার ওর স্কুলে যেতেও সুবিধা হবে। ভবিষ্যতেও যতটুকু পাশে থাকা সম্ভব, নিশ্চয়ই থাকবো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, উনি যেন এই ধরনের শিশুদের সুস্থ করে দেন!” রূপসা’র জন্য এই প্রার্থনা-ই করছেন আপামর মেদিনীপুর বাসীও।