দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, কলকাতা ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৮ অক্টোবর: মনে অনেক ‘স্বপ্ন’ নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার একটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাজধানী কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন সংহিতা (নাম পরিবর্তিত)। কলকাতার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা (Journalism and Mass Communication) বিষয়ে ডিগ্রি লাভের পর, কলকাতা-কেন্দ্রিক একাধিক ডিজিটাল মিডিয়াতে গত প্রায় চার বছর ধরে সুনামের সাথে কাজ করে চলেছেন মেদিনীপুরের মেয়ে সংহিতা (নাম পরিবর্তিত)। সেই সংহিতারই মারাত্মক অভিযোগ বা অভিজ্ঞতা ঘিরে এই মুহূর্তে উত্তাল বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংবাদমাধ্যম জগত। গতকাল অর্থাৎ রবিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুর নাগাদ কার্যত বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের ফেসবুক লাইভে এসে ‘সংহিতা’ (নাম পরিবর্তিত) জানান তাঁর ‘ঘৃণ্য’ অভিজ্ঞতার কথা! কাঁদতে কাঁদতে সংহিতা বলেন, “চার বছর সাংবাদিকতা করছি, কিন্তু এত খারাপ অভিজ্ঞতা আমার কখনও হয়নি! আসলে পোটেনশিয়াল রেপিস্ট এরাই। এদের চিনে রাখা দরকার।” সংহিতার অভিযোগ ছিল বর্ষীয়ান সিপিআইএম নেতা তথা বরাহনগরের প্রাক্তন বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে।
রবিবার (২৭ অক্টোবর) সকালে তন্ময়ের বাড়িতে তাঁর ইন্টারভিউ বা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তন্ময়ের অভব্যতা বা অশালীন আচরণ তথা শারীরিক হেনস্থার ‘শিকার’ হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন সংহিতা (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর সহকর্মী অর্থাৎ ক্যামেরাম্যান (ভিডিও জার্নালিস্ট)-র সামনেই ৬৭ বছর বয়সী প্রাক্তন বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য তাঁর কোলে বসে পড়েন বলে অভিযোগ সংহিতার। এর আগেও একাধিকবার তন্ময় ভট্টাচার্যের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে তাঁর কিছু ব্যবহার ‘খারাপ’ লেগেছিল বলেও জানান সংহিতা। তবে, রবিবার যেভাবে সরাসরি শারীরিক নির্যাতন বা হেনস্থার শিকার হতে হয়, তাতে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে যান বছর ২২-২৩’র সংহিতা। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন তিনি। এরপরই, নিজের সংস্থার অর্থাৎ ডিজিটাল মিডিয়ার (বা, নিউজ পোর্টালের) সাহায্য নিয়ে বরাহনগর থানায় অভিযোগ জানান তিনি। সেই সঙ্গে ফেসবুক লাইভে এসেও নিজের কুৎসিত বা ঘৃণ্য অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে এও জানান, এর আগেও ওই বাম নেতা কারণে-অকারণে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁর শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করতেন। তবে, পেশাদারিত্বের কারণেই সেসব বিষয় এড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সংহিতাকে সমর্থন করে, ওই ফেসবুক লাইভের কমেন্টে কলকাতার আরও কয়েকজন মহিলা সাংবাদিক জানান, তন্ময় তাঁদের সঙ্গেও এমনটা করার চেষ্টা করেছেন! সংহিতার এই ফেসবুক লাইভ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে ফেসবুকে। বইতে থাকে নিন্দার ঝড়! সিপিআইএমের তরফে তন্ময়কে রবিবার সন্ধ্যার মধ্যেই ‘সাসপেন্ড’ করা হয় এবং অভ্যন্তরীণ তদন্তের কথা জানানো হয়। সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিম জানিয়ে দেন, তাঁদের দল এই ধরণের আচরণ অতীতেও বরদাস্ত করেনি। এখনও করবেনা। তন্ময়কে সাসপেন্ড করে দল তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে বলেও জানান সেলিম। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ‘বহিষ্কার’ করা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক।
‘আত্মপক্ষ’ সমর্থন করে রবিবারই তন্ময় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানান, তিনি ইয়ার্কি বা রসিকতা করেই এই ধরণের আচরণ করেছেন। বলেন, মেয়েটি এর আগেও অন্তত দশবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এর আগেও তিনি ইয়ার্কি করেছেন। কিন্তু, এবার কি এমন হয়ে গেল যে মেয়েটি তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনলেন! ষড়যন্ত্রের অভিযোগও করেন তন্ময়। যদিও, তন্ময়ের নিজের দলও তাঁর এই আচরণকে সমর্থন করেনি বা প্রশ্রয় দেয়নি। অন্যদিকে, সোমবার দুপুরেই তন্ময়কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে বরাহনগর থানা। আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে তন্ময় থানায় পৌঁছেও গিয়েছেন। জামিন অযোগ্য ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। এদিকে, আজ অর্থাৎ সোমবার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সংহিতা একটি পোস্ট করে জানায়, “আমার অভিযোগ কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়। তাহলে রাজনৈতিক চক্রান্তের কথা বলছেন কি করে অভিযুক্ত? ভিক্টিম ব্লেমিং যে আমাদের দেশে হয়, তা আমার অজানা নয়। মানসিকভাবে এসব সয়ে নিচ্ছি। কিন্তু, কিছু প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে অনেকেরই মনে এবং ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে তাই এই লেখা। কোনো রাজনৈতিক দল কারোর বিচার করতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাহলে দেশ জুড়ে সালিশি সভা করেই সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়া যেত। আইন-আদালতের প্রয়োজন পড়ত না। অভিযুক্তকে দল বহিষ্কার করেছে সেটা তাদের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে। তবে, বিচার দেবে আইন-আদালত। পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছি। তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবে আশা করি। এটা রাজনীতি করার সময় নয়, সমাজ সংস্কারের সময়। আশা করি সবাই নিজের রাজনৈতিক পরিচয়টা সাইডে রেখে এর প্রতিবাদ করবেন। লড়াইয়ে ছিলাম, লড়াইয়ে আছি। যাঁরা পাশে থাকলেন, তাঁদের ধন্যবাদ। আর যাঁরা দোষারোপ করছেন, তাঁদের ভুলটা আশা করি ভেঙে যাবে।”