দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৩ এপ্রিল: একসঙ্গে দু-দুটি বিরল রোগ! দু-তিন বছর আগে ‘অরণ্য সুন্দরী’ ঝাড়গ্রামের তরতাজা এক কিশোর হঠাৎ করেই শয্যাশায়ী হয়ে যায়। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, বুকে ব্যথা, জ্বর, কাশি- সব একসঙ্গে। সামান্য দিনমজুর পরিবারের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে! আর সেই অবস্থা থেকেই জঙ্গল অধ্যুষিত ঝাড়গ্রাম জেলার বেলিয়াবেড়া থানা এলাকার দিনমজুর পরিবারের সন্তান সন্তোষ হেমব্রমকে যেন এক নতুন জীবন ‘উপহার’ দিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকেরা। মাস তিনেক আগেও যে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ উত্তাল হয়েছিল স্যালাইন কাণ্ডে এক প্রসূতির মৃত্যুকে ঘিরে! পরিবার সূত্রে জানা যায়, সন্তোষ সবে তখন দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠেছেন। মাঝেমধ্যেই বুকে ব্যথা আর তা থেকে জ্বর অনুভব করতেন। স্থানীয় কোয়াক ডাক্তার (গ্রামীণ চিকিৎসক) এবং গোপীবল্লভপুর হাসপাতালে দেখিয়ে ওষুধ খেলে কিছুটা উপশম হত। তবে রোগ পুরোপুরি সারার বদলে, ধীরে ধীরে সন্তোষের কষ্ট বাড়তে শুরু করে। এরপর কোমরে ব্যথা, হাত-পায়ের জোর কমে যাওয়া বা দুর্বল হয়ে পড়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। সঙ্গে জ্বর আর শুকনো কাশি। ক্রমেই হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে সন্তোষ শয্যাশায়ী হয়। তবে, কোমর থেকে মেরুদণ্ড অবধি এতটাই ব্যথা হত, ভালো করে শুতেও পারতেন না বলে দাবি সন্তোষের পরিবারের। গত দু’তিন বছর ধরে এভাবেই চলতে থাকে। মাস দেড়েক আগে বছর ২২-র সন্তোষকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের আউটডোরে নিয়ে আসেন পরিবারের লোকজন। মেদিনীপুর মেডিক্যালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে জানতে পারেন, সন্তোষ আক্রান্ত হয়েছেন অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিসে। যা অত্যন্ত বিরল রোগ। তবে, সন্তোষের শুকনো কাশি বুকে ব্যথা শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের ফোলা ভাব দেখে বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর যুগলকিশোর কর ও অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. বিকাশ শেঠের নেতৃত্বাধীন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকেরা অনুমান করেন, সন্তোষের শরীরে শুধু অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস নয়, আরো কোন রোগ বাসা বেঁধেছে!

thebengalpost.net
মেদিনীপুর মেডিক্যালের চিকিৎসকদের সঙ্গে সন্তোষ:

thebengalpost.net
বিজ্ঞাপন (Advertisement):

প্রথমে টিবি মনে হলেও, পরীক্ষা করে দেখা যায় তা নয়। তারপরই বাইসেপস মাসলের বায়োপসি করে দেখা যায়, সন্তোষ অ্যান্টি-সিন্থেটেজ সিনড্রোমেও আক্রান্ত! একসঙ্গে এই দু’টি রোগ সারা বিশ্বে প্রায় বিরলতম বলেই দাবি চিকিৎসকদের। এরপরই, মেদিনীপুর মেডিক্যালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান (HOD) সহ দুই সিনিয়র চিকিৎসকের নির্দেশে মেডিসিন বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের পিজিটি ডঃ স্পন্দন চৌধুরী, ডঃ অনীক দাসরা সন্তোষের চিকিৎসা শুরু করেন। গত চল্লিশ দিনে সন্তোষের শারীরিক অবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়। সন্তোষ এখন বসতে পারছে। কোমর থেকে শুরু করে বুকের সেই ব্যথা আর নেই! কাশিও বন্ধ হয়েছে। নিজের হাতে খাওয়া-দাওয়া সহ টুকটাক কাজও করতে পারছে সন্তোষ। শনিবার দুপুরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বেডে বসে সন্তোষ বলে, “এখন আমি অনেকটাই ভালো আছি। বসতেও পারছি শুধু এখনো হাঁটতে পারছি না!” মেডিসিন বিভাগের পিজিটি স্পন্দন বলেন, “আমরা মেডিক্যাল হিস্ট্রি দেখে জেনেছি, সারা বিশ্বে এর আগে এই ধরনের রোগ মাত্র দু’টি নথিভুক্ত (রিপোর্টেড) হয়েছে। আমরা এটা নথিভুক্ত (রিপোর্ট) করলে, তিন নম্বর হবে। আর ভারতে এই বিরলতম রোগ এই প্রথম নথিভুক্ত (রিপোর্টেড) হবে।” স্পন্দন, অনীক, অর্ক, অরিজিৎ-রা এও জানান, “সন্তোষ দু’টি বিরল অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রথমটি (অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস) মূলত মেরুদণ্ড ও জয়েন্টকে শক্ত করে দেয়, দ্বিতীয়টি (অ্যান্টি-সিন্থেটেজ সিনড্রোম) পেশি দুর্বল করে ও ফুসফুসে প্রদাহ ঘটায়। একই সাথে দুটি রোগই একজন মানুষের শরীরে ঘটেছে, সারা বিশ্বে এই ধরনের মাত্র দু’টি কেস এর আগে নথিভুক্ত হয়েছে।”

মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকেরা এও জানান, “প্রায় দেড় মাস আগে সন্তোষ প্রথম যখন আসে, বসতে পারা তো দূরের কথা বসিয়ে দিলেও ওর গোটা শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিল! হাঁটু, গোড়ালি, হাত বেন্ড করতে বা মুড়তে পারছিল না। এখন সেগুলো প্রায় নেই। ও হাঁটতেও পারবে। তবে, সেজন্য ওর হাঁটু দুটি রিপ্লেসমেন্ট করা প্রয়োজন। এই নি-রিপ্লেসমেন্টের বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলছি।” মেডিসিন বিভাগের প্রধান প্রফেসর যুগলকিশোর কর বলেন, “বাইসেপস মাসলের বায়োপসি করে আমরা এই বিরল রোগ নির্ণয় করতে পেরেছি। আমাদের পিজিটি টিম তথা জুনিয়র চিকিৎসকেরা দুর্দান্ত কাজ করেছে।” মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের তরফে এদিন এও জানানো হয়, বর্তমানে সন্তোষের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ও ইনফ্লিক্সিম্যাব ব্যবহার করা হয়েছে। ফিজিওথেরাপি ও শ্বাস প্রশমনের প্রশিক্ষণও চলছে। উপসর্গের উন্নতি দেখা যাচ্ছে। মেডিসিন বিভাগের তরফে ডঃ স্পন্দন চৌধুরী এও বলেন, “আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই সন্তোষকে ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রত্যেক ছয় সপ্তাহ ছাড়া সন্তোষকে ইনফ্লিক্সিম্যাব ইনজেকশন দু’টো করে, টোটাল ২০০ মিলিগ্রাম নিতে হবে। রাজ্যের প্রতিটি গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজে এই ইনজেকশনটি বিনামূল্যে মেলে, যখন সাপ্লাই থাকে।” মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপার প্রফেসর ইন্দ্রনীল সেন বলেন, “আমাদের মেডিসিন বিভাগ প্রায় অসাধ্য সাধন করেছে। আমরা গর্বিত ওঁদের জন্য। আশা করছি, ঠিকঠাক সাপ্লাই থাকলে এই ইনজেকশন প্রতি ছয় সপ্তাহ ছাড়া সন্তোষকে আমরা দিতে পারব।” মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন সন্তোষের মা ফুলমণি হেমব্রম। তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে যেন ও নতুন জীবন পেল!”

thebengalpost.net
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা: