দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৮ জুন: একদিকে ফল খারাপ, অন্যদিকে দিলীপের দোষারোপ আর অন্যদিকে ‘শক্তিশালী’ শাসকের আক্রমণ আর শাসানি-তে ঘরছাড়া শ’য়ে শ’য়ে ঘরছাড়া কর্মীরা! ত্র্যহস্পর্শে টালমাটাল মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলা বিজেপি। দূর (কলকাতা) থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে দিলীপ ঘোষ জানিয়ে দিয়েছেন, “আমাকে হয়তো হারানোর জন্যই মেদিনীপুর থেকে বর্ধমানে পাঠানো হয়েছিল! সেই উত্তর খুঁজছি। তবে, বর্ধমান হোক কিংবা মেদিনীপুর, কর্মীদের পাশে আমি ছিলাম, আছি, থাকব!” একইসঙ্গে দিলীপের কটাক্ষ, “মেদিনীপুর ১ লক্ষ ভোটে জেতা সিট! মাঝখান থেকে দু’টো সিটই হারতে হল!” জল্পনা বাড়িয়ে দিলীপ আরও বলেন, “ওখানকার (মেদিনীপুরের) কর্মীরা হতাশ! আমি খুব তাড়াতাড়ি মেদিনীপুর যাব।” যদিও, শনিবার সকালে অবশ্য দিলীপ-কে মাছ ধরতে দেখা গেছে বসিরহাট এলাকায়! এদিকে, মেদিনীপুর লোকসভা আসনের ‘পরাজিত’ প্রার্থী তথা আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়েছেন, দিলীপ ঘোষ ২০১৯ সালে মেদিনীপুর লোকসভায় যে পরিমাণ ভোট পেয়েছিলেন, তার থেকে তিনি মাত্র ১০ হাজার ভোট কম পেয়েছেন! অগ্নি’র সংযোজন, “অমিত শাহ জি এবং নাড্ডা জি আমাকে ফোন করে এখানে দাঁড়াতে বলেছিলেন। এর মধ্যে কোনও চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র আছে বলে আমার তো জানা নেই!” তিনি এও জানিয়েছেন, “আগামী দু’মাস আমি মেদিনীপুরেই থাকব। ভবিষ্যতেও এখানকার কর্মীদের পাশে থাকব। আসানসোলের মানুষের পাশেও আছি, মেদিনীপুরের আক্রান্ত কর্মীদের পাশেও থাকব।” আজ, শনিবার বিকেলেও মকরামপুর এলাকায় বিজেপি কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনেই রওনা হয়েছেন অগ্নিমিত্রা।
প্রসঙ্গত, জেলা জুড়ে বিজেপি কর্মীরা শাসকদলের হাতে মার খেয়ে বা শাসানিতে ভয় পেয়ে ঘরছাড়া হয়েছেন বলে অভিযোগ। মেদিনীপুর শহরের জেলা কার্যালয়েই প্রায় ৪০-৫০ জন ঘরছাড়া কর্মী আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে আবার খোদ জেলা শহর মেদিনীপুরের ‘ডাকাবুকো’ বিজেপি নেতা শুভজিৎ রায় (বান্টি) সহ তিনজনকে শুক্রবার পুলিশ গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তৃণমূলের বিজয় মিছিল থেকে শুভজিতের বাড়িতে বোম ছোঁড়া হয়েছিল অভিযোগ তুলে শুক্রবার বিজেপি কর্মীর মেদিনীপুর শহরে পথ অবরোধ করার সময়ই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। শুক্রবার বিকেলেই অবশ্য মেদিনীপুর আদালত থেকে শুভজিতরা জামিন পেয়ে যান। সবমিলিয়ে বিধানসভা উপনির্বাচনের আগে রীতিমত ‘টালমাটাল’ পরিস্থিতি মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলা বিজেপি-তে। যদিও, তা মানতে নারাজ বিজেপি-র রাজ্য সাধারণ সম্পাদিকা অগ্নিমিত্রা পাল। তিনি বলেন, “এটা ঠিক যে আমরা অনেক লড়াই করেও মাত্র ২৭ হাজার ভোটে হেরে গেছি। হয়তো আমরা সমস্ত মানুষকে, বিশেষত মহিলাদের বোঝাতে পারিনি লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দেবেন না না! এই ভোট সারা দেশের উন্নয়নের ভোট, নিরাপত্তার ভোট। তবে, এটাও ঠিক মেদিনীপুর সদর, খড়্গপুর শহর, এগরা সহ অনেক এলাকার মানুষই সবদিক বিবেচনা করে ভোট দিয়েছিলেন। সেজন্যই আমরা প্রায় ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার ভোট পেয়েছি। লড়াই চলবে। আগামীদিনে এই সিট পুনরায় আমরা উদ্ধার করব। আর, কর্মীদের পাশে সবসময়ই আমি আছি।” কিন্তু, মেদিনীপুরের বিধায়ক (জুন মালিয়া)-ই যেহেতু সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, সামনেই তো লড়তে হবে উপনির্বাচনে! অগ্নিমিত্রা বলেন, “উনি (জুন মালিয়া) ওনার নিজের বিধানসভা এলাকায় মাত্র ২১৭০ ভোটে এগিয়ে আছেন। তাও, এই বিধানসভার অধীন শালবনীর ৫টি অঞ্চল থেকে সাড়ে ৬ হাজার লিড পেয়েছেন বলেই এগিয়ে থাকতে পেরেছেন। মেদিনীপুর শহরে উনি কয়েক হাজার ভোটে পিছিয়ে আছেন। আমাদের দলের যিনি প্রার্থী হবেন, আশাকরি তাঁর লড়াই খুব একটা কঠিন হবেনা! কিন্তু, কে হবেন বিজেপি-র প্রার্থী? আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা বলেন, “সেটা দল ঠিক করবে।” দিলীপ-জল্পনা নিয়ে কিছু বলতে চাননি অগ্নি।
অপরদিকে, উপনির্বাচনের আগে তৃণমূল শিবির তুলনামূলকভাবে স্বস্তিতে থাকলেও, মেদিনীপুর শহরের ১৫টি ওয়ার্ডে (২৫টির মধ্যে) বিজেপি-র থেকে পিছিয়ে থাকায় কিছুটা ব্যাকফুটেও! খোদ পৌরপ্রধান তথা জুন মালিয়া-র নির্বাচনী কমিটির চেয়ারম্যান সৌমেন খানের ওয়ার্ডেই (১৮) প্রায় ১১০০ ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল। শহর সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডব (১৯) এবং শহর মহিলা সভানেত্রী মৌ রায়ের ওয়ার্ডেও (৫) যথাক্রমে ৮০০ ও ২৪৩ ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল। এমনকি, জুনের মেদিনীপুর শহর নির্বাচনী কমিটির আহ্বায়ক তথা মেদিনীপুর পৌরসভার সিআইসি (পূর্ত দফতর) সৌরভ বসু’র ওয়ার্ডেও (৯) ২০টি ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল। এছাড়া, ৪,৬,৭,৮,১০, ২০, ২৪, ২৫- প্রভৃতি ওয়ার্ডগুলিতে বড়সড় ব্যবধানে পিছিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস। এমনকি, জেলা তৃণমূলের সভাপতি সুজয় হাজরা-র ওয়ার্ডেও (২২) পৌরভোটের ৩ হাজারের লিড কমে ৪২১- এ দাঁড়িয়েছে! শনিবার (৮ জুন) নেত্রীর ডাকে কলকাতার বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার আগে, দুপুর নাগাদ সুজয় বলেন, “পৌর নির্বাচন আর লোকসভা ভোট এক নয়। আবার লোকসভা ভোট আর বিধানসভা ভোটও এক নয়! তবে এটা ঠিক, মেদিনীপুরের ক্ষেত্রে আমাদের বিধায়কই যেহেতু লোকসভার প্রার্থী হয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে মেদিনীপুর শহরে আমরা আরও ভাল ফল প্রত্যাশা করেছিলাম। কেন হয়নি, তা নিশ্চয়ই আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে, শহরের সংগঠনকে ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগানো হয়নি। প্রার্থী নিজে মেদিনীপুর শহরের জন্য যে নির্বাচনী কমিটি গড়েছিলেন, সেখানে ওয়ার্ড সভাপতিরা গুরুত্ব না পাওয়ার কারণেই হয়তো এতটা খারাপ ফল হয়েছে!তবে, উপ-নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বেনা।” উপ-নির্বাচনে নাকি আপনিই তৃণমূলের প্রার্থী হচ্ছেন? শনিবার দুপুরে কলকাতা রওনা হওয়ার আগে ‘আত্মবিশ্বাসী’ সুজয় চেনা মেজাজেই বলেন, “দল যাকে ঠিক করবে, তিনিই প্রার্থী হবেন!”