দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, কলকাতা, ২৮ আগস্ট: ৯৮ এইচ/১, নারকেলডাঙা মেন রোড। পাশাপাশি টালির চালের পর পর ঘর। সেই বাড়িরই একটি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকতেন কৃষ্ণকান্ত রায়। ওই বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে ৬৯ নম্বর নারকেলডাঙা মেন রোডে ছিল কৃষ্ণকান্তের দোকান। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। অবসরের পর গৃহশিক্ষকতা করতেন। সঙ্গে, গৃহশিক্ষক খুঁজে দেওয়ার কাজ-ও করতেন। সেই উপার্জনে কোনওমতে চলে যেত সংসার। ২০১১ সাল পর্যন্ত এমনই সাদাসিধে জীবনযাপন ছিল কৃষ্ণকান্ত রায়, তাঁর ছেলে প্রসন্ন কুমার রায়-দের। ক্ষমতার পালাবদলের পর পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রী হলেন। কয়েক বছর পর শিক্ষামন্ত্রী। তারপর থেকেই নজিরবিহীন উত্থান সম্পর্কে তাঁর ভাগ্নিজামাই প্রসন্ন’র। এসএসসি’র ‘মিডল ম্যান’ হিসেবে কাজ করেই সামান্য রং মিস্ত্রি থেকে কার্যত ধনকুবের হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দেশের একাধিক শহরে, এমনকী দুবাইতে হোটেল রয়েছে তাঁর। নিউ টাউনে বিলাসবহুল ‘আইডিয়াল ভিলাস’ (Ideal Villas)। রয়েছে একাধিক বাগানবাড়ি। সিবিআই সূত্রে দাবি, SSC দুর্নীতিতে ধৃত আরেক দালাল প্রদীপ সিং ওরফে ছোটু-কে জেরা করে প্রসন্নের নাম পান তাঁরা। ধৃতের সঙ্গে একই সংস্থায় কাজ করতেন প্রসন্ন। দু’জনকেই আপাততো হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। তাঁদের একসঙ্গে বসিয়ে জেরা করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রসন্ন কুমার রায়ের নিউটাউনের একটি বিলাসবহুল ভিলা (আইডিয়াল ভিলায়)’র পাঁচ তলায় অফিস ছিল। সেখানে অনেক ছেলে-মেয়ে কাজ করত। ওই অফিস থেকেই রিয়েল এস্টেট, হোটেল ও রিসর্টের ব্যবসা পরিচালনা করা হত। ওই অফিসেই কাজ করতেন প্রদীপ সিং। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই প্রসন্ন-কে গ্রেফতার করা হয়। প্রসন্ন’র গ্রেফতারির পর সেই অফিস এখন খাঁ খাঁ করছে! সূত্রের খবর অনুযায়ী, প্রসন্ন কুমার রায়ের একাধিক কোম্পানি রয়েছে। সেই কোম্পানির নামে তাঁর প্রচুর সম্পত্তিও রয়েছে। নিউটাউন-রাজারহাট এলাকায় প্রচুর সম্পত্তি আছে তাঁর। রাজারহাটের ধারসা মৌজায় প্রায় ১০ কাটা জায়গার উপর বিলাসবহুল বাংলো। বলাকা আবাসনেও ফ্ল্যাট। সেখানেও মাঝেমধ্যে যেতেন প্রসন্ন কুমার রায়। গত দু’মাস আগে তিনি ওই ফ্ল্যাটে যান। শুধু তাই নয় নিউটাউনের একাধিক জায়গায় জমি, গেস্ট হাউজ রয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতেও রয়েছে রিসর্ট, বাংলো ও হোটেল। নিউটাউনের বাসিন্দারা প্রসন্ন কুমার রায়কে চেনেন এলাকার বড় ব্যবসায়ী হিসেবেই। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গ্রেফতারি ঘিরে শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য! এদিকে, সিবিআই-এর হাতে আসা তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী, স্কুল সার্ভিস কমিশনের ‘মিডল ম্যান’ হিসেবে কাজ করেই পার্থ’র ভাগ্নিজামাইয়ের এই বিস্ময়কর উত্থান! তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল শান্তি প্রসাদ সিনহা সহ বিকাশ ভবনের আধিকারিকদের। গ্রাউন্ড লেভেল থেকে অর্থাৎ অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের থেকে টাকা আসতো আব্দুল আমিনের মতো শিক্ষকদের মাধ্যমে। যিনি পাথরঘাটা স্কুলের শিক্ষক এবং ১১৩ জনকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। তারপর তা প্রদীপ-প্রসন্ন’র হাত ঘুরে পৌঁছে যেত এস.পি.সিনহা থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। আপাততো এই রহস্য উদ্ধার করতে পেরেছে সিবিআই। সূত্রের খবর অনুযায়ী, আব্দুল আমিন নামে ওই শিক্ষক তথা এসএসসি’র দালাল-কেও খুঁজছে সিবিআই!
এদিকে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক প্রসন্ন কুমার রায় ওরফে রাকেশ (ডাকনাম) যে এভাবে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাবেন, তা ভাবতে পারেননি তাঁর শিক্ষক বাবা কৃষ্ণকান্ত রায় থেকে শুরু করে এলাকাবাসী। নারকেলডাঙার যে বাড়িতে দীর্ঘ দিন ভাড়া থেকেছেন প্রসন্নেরা, সেই বাড়ির মালিক শিবানী বিশ্বাস গ্রেফতারের খবর শুনেছেন। কিন্তু, মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না! প্রসন্নকে তাঁরা রাকেশ (ডাকনাম) নামেই চেনেন। তিনি বলেন, “রাকেশরা এই বাড়িতে বহু দিন ভাড়া ছিল। আমি বিয়ে করে এ বাড়িতে আসার পর থেকেই দেখে আসছি। কয়েক বছর আগে ওরা এই বাড়ি ছেড়ে নিউটাউনের বাড়িতে চলে যায়।” রাকেশ ওরফে প্রসন্ন-দের সম্পর্কে শিবানী বলেন, “রাকেশের বাবা শিক্ষকতা করতেন। গোটা পরিবারটাই শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমাদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক। যতদূর মনে পড়ছে, ২৫০-৩০০ টাকা ভাড়া দিতেন ওঁরা। কী ভাবে এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল রাকেশ, বুঝতে পারছি না।” বাড়ি মালিক শিবানীর মেয়ে জয়শ্রী আর প্রসন্ন পিঠোপিঠি বড় হয়েছেন। রাকেশের কথা শুনে ভেঙে পড়েছেন তিনিও। তিনি বলছেন, “আমরা তো ওঁকে রাকেশদা বলেই ডাকি। রাকেশদা’র ব্যবসা বড় হল, আর ওঁরা সবাই নিউটাউন চলে গেলেন। আমাদের সঙ্গে রাকেশ দা’র খুবই ভাল সম্পর্ক। বলতে পারেন, আমরা একই সঙ্গে বড় হয়েছি। রাকেশ দা যে এই মামলায় জড়িয়ে পড়বে, আমরা ভাবতে পারছি না!”