thebengalpost.net
রাণীর গড়ের বর্তমান প্রবেশদ্বার :

মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১ ফেব্রুয়ারি: এর আগে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ১০-টি মন্দির বা স্থাপত্য বা স্মৃতিস্তম্ভ রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধীন ‘স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ (State Protected Monument বা রাজ্য সংরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ) এর স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেই তালিকায় যুক্ত হতে চলেছে, চুয়াড় বিদ্রোহের নেত্রী তথা পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী রাণী শিরোমণি’র স্মৃতিধন্য কর্ণগড়। দীর্ঘ দাবি ও আবেদনের পর এই স্বীকৃতি মিলেছে চলেছে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই। সূত্রের খবর অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসের যেকোনো দিন বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই ‘সুখবর’ শোনাবে মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনের অধীন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর। তবে, অনেকের কাছেই হয়তো অজানা ছিল যে, কর্ণগড়ের ঐতিহ্যমণ্ডিত মহামায়া মন্দিরের অংশবিশেষ দু’টি মন্দির বা স্থাপত্য ইতিপূর্বে রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক স্বীকৃতি পেয়ে বসে আছে! জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার যে ১০-টি (রাজ্যের ১০৯-টি) স্থাপত্য ইতিপূর্বে ‘স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ এর স্বীকৃতি পেয়েছিল, সেই তালিকায় আছে, কর্ণগড়ের ‘মহামায়া মন্দির’ এবং ‘দন্ডেশ্বর মন্দির’। কথিত আছে যে, অধিষ্ঠাত্রী দেবী মহামায়ার মন্দিরে বসে কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য সাধনা করতেন। প্রচলিত রয়েছে, এখানে বসেই রামেশ্বর তাঁর বিখ্যাত ‘শিবায়ন’ কাব্য রচনা (আনুমানিক ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত) করেছিলেন। রামেশ্বরের কাব্যে কর্ণগড়ের উল্লেখও রয়েছে- “যশোবন্ত সিংহ/ সর্বগুণযুত/ শ্রীযুত অজিত সিংহের তাত। মেদিনীপুরাধিপতি/ কর্ণগড়ে অবস্থিতি/ ভগবতী যাহার সাক্ষাৎ।”

thebengalpost.net
সৌন্দর্যায়নের পর কর্ণগড়ের মহামায়া মন্দির ও দন্ডেশ্বর মন্দির :

সেই তিন শতাধিক প্রাচীন মন্দির’যে ইতিমধ্যেই প্রত্নতাত্ত্বিক‌‌ মর্যাদা পেয়েছে, তা কর্ণগড় বাসী থেকে জেলাবাসী, অনেকের কাছেই অজানা ছিল! আবার, মন্দির কমিটি থেকে শুরু করে,‌ শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁরা অনেকেই এই বিষয়টি জানতেন; তবে ‘স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ এর কোনও স্বীকৃতিসূচক বোর্ড বা ফলক-এই মুহূর্তে না থাকায় (বা, উঠে যাওয়ায়), অনেকেই তা বিস্মৃত হয়েছিলেন। এই বিষয়ে জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক বরুণ মন্ডল সোমবার জানিয়েছেন, “আমরা কর্ণগড়ের ওই দুটি মন্দির পরিদর্শনে যাব। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে পদক্ষেপ করা হবে।” অন্যদিকে, রাণী শিরোমণি’র স্মৃতিধন্য গড়ও যে খুব তাড়াতাড়ি ‘স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ এর আওতায় আসতে চলেছে তাও জানিয়েছেন তিনি। শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ সন্দীপ সিংহ জানিয়েছেন, “খুবই গর্বের ও আনন্দের কথা যে, রাণী শিরোমণি’র গড় ‘স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ এর স্বীকৃতি পেতে চলেছে। এজন্য, তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ সহ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তবে, মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভূঁইয়া, বিধায়ক জুন মালিয়া, প্রাক্তন রাজ্য সভার সাংসদ কুনাল ঘোষ-প্রমুখদের অবদানও অনস্বীকার্য। তবে, রাণী শিরোমণি ঐক্যমঞ্চের পক্ষ থেকে গড় সংরক্ষণ ও সংস্কার করার যে দাবি রাখা হয়েছে, সেই দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমরাও সরকারের কাছে আবেদন করছি, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যেন এই জরাজীর্ণ গড় সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও সংস্কার করা হয়।” সন্দীপ এও জানিয়েছেন, “মহামায়া মন্দির ও দন্ডেশ্বর মন্দির-ও যে প্রটেক্টেড মনুমেন্টের অধীন তা সত্যিই আমরা বিস্মৃত হয়েছিলাম। জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের কাছে আমাদের আবেদন সেখানেও যেন‌ স্বীকৃতিসূচক বোর্ড বা ফলক লাগানো হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে শালবনী পঞ্চায়েত সমিতির তরফে পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হবে।” অন্যদিকে, রাণী শিরোমণি’র বীরগাথা-কে অবিলম্বে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন, ইতিহাস গবেষক ও আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভকত সহ সুশীল সমাজের অনেকেই।

thebengalpost.net
রাণী শিরোমণি’র গড় :

অপরদিকে, কর্ণগড়ের দু’টি মন্দির ছাড়াও, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার যে আরও ৮-টি মন্দির বা স্থাপত্য ‘স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ এর স্বীকৃতি আগেই পেয়েছে, সেগুলি হল, যথাক্রমে- ১. খড়্গপুর মালঞ্চ’র দক্ষিণা কালীর মন্দির ২. চন্দ্রকোনার জোড়বাংলো মন্দির ৩. চন্দ্রকোনার শান্তিনাথ শিব মন্দির ৪. ঘাটালের রাধানগর এলাকার রাধানাথ মন্দির ৫. দাসপুরের রাধাগোবিন্দ রাধারাম মন্দির ৬. ঘাটালের রাধাকান্তপুরের গোপীনাথ মন্দির ৭. দাসপুরের গোপীনাথ মন্দির ৮. দাঁতনের সখীসোনা। এছাড়াও, রাণী শিরোমণি’র স্মৃতিধন্য কর্ণগড়ের মহামায়া মন্দির ও দন্ডেশ্বর মন্দির এই তালিকায় ছিল। এবার, রাজ্যের ১১০ তম এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ১১ তম স্থাপত্য হিসেবে সেই তালিকায় আসতে চলেছে রাণী শিরোমণি’র গড় বা জরাজীর্ণ দুর্গ-টিও। স্মরণীয় যে, জঙ্গল অধ্যুষিত রাঢ় বঙ্গের সাঁওতাল, ভূমিজ, লোধা প্রভৃতি ‘চুয়াড়’ (পরিশীলিত অর্থে আদিম, অন্ত্যজ, খেটে খাওয়া মানুষ) সম্প্রদায়ের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কর্ণগড়ের এই রাণী শিরোমণি লড়াই করেছিলেন এই কর্ণগড় থেকে। ইতিহাস বলছে, চুয়াড় বিদ্রোহের (১৭৬৯-১৭৯৯) শেষ লড়াইতে বা দ্বিতীয় পর্যায়ের (১৭৯৮-১৭৯৯) লড়াইতে রাণী’র ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। আদিবাসী প্রজা বা কৃষকদের থেকে অন্যায় ভাবে রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে তিনি এই কৃষকদের আর্থিকভাবে সাহায্যের মধ্য দিয়েই নয়, শশরীরেও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। জগন্নাথ সিং, দুর্জন সিং’দের পর রানী শিরোমণিই চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইংরেজরা শিরোমণিকে চুয়াড় বিদ্রোহের মূল নেত্রী ঘোষণা করে পরোয়ানা জারি করে। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনী পৌঁছলে কর্ণগড় থেকে গোপন সুড়ঙ্গপথে মেদিনীপুরের আবাসগড় প্রাসাদে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে যান রাণী। তাঁকে বন্দি করে কলকাতায় নিয়ে যায়, ইংরেজরা। প্রাসাদ লুঠ করে ধ্বংস করে দেয় ইংরেজ সৈন্যরা। মুক্তি পাওয়ার পরে শিরোমণি আর কর্ণগড়ে ফিরে যাননি। মেদিনীপুরের আবাসগড়ের প্রাসাদে শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন তিনি। ১৮১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবাসগড়েই তাঁর মৃত্যু হয় বলে ঐতিহাসিকদের মত। পারাং নদী পরিবেষ্টিত রানী শিরোমণি’র সেই গড় বা রাজপ্রাসাদ-কে কেন্দ্র করেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন এক ঐতিহাসিক পর্যটনস্থল গড়ে তুলেছে সম্প্রতি। তবে, সৌন্দর্যায়ন হলেও, এখনও ‘সংরক্ষণ’ করা হয়নি ঐতিহাসিক সেইসব জরাজীর্ণ মন্দির ও স্থাপত্যগুলিকে। বরং গড়ের আশেপাশে আরও দু’টি সুপ্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পেয়েছেন রাণী শিরোমণি ঐক্য মঞ্চের সদস্যরা। এবার, সেই গড় রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধীন প্রত্নতত্ত্বের মর্যাদা পেতে চলায় খুশি শিরোমণি ঐক্য মঞ্চের নিসর্গ নির্যাস মাহাত, তন্ময় সিংহ, তীর্থঙ্কর ভকত থেকে শুরু করে আপামর এলাকাবাসী।

thebengalpost.net
রাণীর গড়ের বর্তমান প্রবেশদ্বার :