মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩১ জুলাই: জলবন্দি গ্রাম থেকে বের করে নিয়ে আসা হল- খাটিয়ায় করে। তবে, আর ফিরে যেতে পারলেন না সেই গ্রামে! সময়ে চিকিৎসা শুরু না হওয়ায় মৃত্যু হল মহিলার। মর্মান্তিক ঘটনাটি এই মুহূর্তে জলবন্দি কেশপুরের। ৮ নং অঞ্চলের খড়িকা গ্রামের শঙ্করী বাগ বৃহস্পতিবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর পরিবার সূত্রে জানা গেল, বৃহস্পতিবার সারা দিন ধরে চলা প্রবল বর্ষণে যখন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুরের একের পর এক গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে, সেই সময়ই রাত্রি ১০ টা নাগাদ একপ্রকার আতঙ্কিত হয়ে বাড়িতেই পড়ে যান এবং প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়েন তিনি। সেই সময় পুরো খড়িকা গ্রামও জলমগ্ন এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রধান রাস্তার সঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে সারা রাত অসুস্থ অবস্থাতেই বাড়িতে পড়ে থাকতে হয় বছর পঞ্চাশের শঙ্করী বাগ’কে। কোনও উপায় না দেখে, সকালেই পরিবার ও গ্রামের লোকেরা খাটিয়ায় করে শঙ্করী দেবী’কে গ্রামের বাইরে নিয়ে আসেন। পরের গ্রাম চড়কা থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে যখন নিয়ে আসা হয়, তখন সকাল প্রায় ১০ টা। এরপর, চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা শুরু করতে করতেই বেলা সাড়ে ১১ টা নাগাদ ওই মহিলার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন মৃতার এক ভাইপো। তবে, মৃত্যু’র পরও ফেরা হলোনা নিজের গ্রামে। প্রশাসনিক সহায়তায় রাত্রি ১০ টা নাগাদ দাহ করা হল, মেদিনীপুর শহরের পদ্মাবতী শ্মশানঘাটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই কেশপুর ব্লকের একের পর এক গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করে। রাত্রি নাগাদ প্রায় পুরো কেশপুর জলের তলায়! খড়িকা গ্রামের শঙ্করী দেবী’র বাড়িতেও তখন এক হাঁটু জল। স্বভাবতই ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে, জিনিসপত্র নিয়ে কি করবেন, এই আতঙ্কে বাড়িতেই একপ্রকার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান! সারা রাত চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয় প্রধান-উপ প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা জানান, “যেভাবে হোক চড়কা গ্রামে নিয়ে আসুন। সেখান থেকে সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সে করে মেদিনীপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেব।” কিন্তু, রাতের মধ্যেই তা সম্ভব হয়না! সকালে সেই ব্যবস্থা হয়। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে! শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শঙ্করী বাগ (৫১)। তাঁর এক ভাইপো মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে দাঁড়িয়ে আফশোস করলেন, “মাত্র ২-৩ ঘন্টা আগে নিয়ে এলেই কাকীমা’কে বাঁচাতে পারতাম! উনি এমনিতেই একটু দুর্বল প্রকৃতির ছিলেন। তবে, গতকাল যে জল আমরা দেখলাম, তাতে উনি কেন যেকোন শক্তসামর্থ মানুষই আতঙ্কিত হয়ে যাবেন। আর, উনি তো একজন মহিলা! কেশপুরে প্রতি বছরই জল ঢোকে, বন্যাও হয়, কিন্তু আমাদের জীবনে এরকম বন্যা দেখিনি! তাতেই সব শেষ হয়ে গেল।” এও জানালেন, “পরিস্থিতি এমনই গ্রামে দাহ করার জায়গা নেই। তাই প্রশাসনের সহযোগিতায় মেদিনীপুরের পদ্মাবতী শ্মশানেই দাহ করতে হচ্ছে। শেষ দেখা দেখতে পারলেন না, বাড়ির কোনো মহিলাই। কাকীমাও সেই যে আমাদের ঘাড়ে চেপে গ্রাম থেকে বেরিয়ে এলেন, আর ফিরতে পারলেন না!” কিন্তু, রাতের মধ্যেই কেন অসুস্থ মহিলাকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসা গেলনা, কোথাও কি প্রশাসনের-ও গাফিলতি থেকে গেল? কেশপুর ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক (BDO) দীপক ঘোষ এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শুভ্রা সেনগুপ্ত’র সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, সম্ভব হয়নি। তবে, স্থানীয় এক পঞ্চায়েত সদস্য জানালেন, “সত্যিই কেশপুরের বুকে এতবড় বিপর্যয় গত ২০ বছরে ঘটেনি! আমরাও অনেক দেরিতে এই খবর পেয়েছি। আফশোস তো হচ্ছেই, অনেক দেরি হয়ে গেল।” তবে, প্রশাসনিক দুর্বলতা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যাই হোক না কেন, ২০২১ এর ৩০ শে জুলাই সকালে যেন শঙ্করী দেবী’র “অন্তর্জলি যাত্রা” ই দেখলো গোটা কেশপুর!