দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৪ মে: ২০০৯ সাল। গোটা জঙ্গলমহল তখন মাওবাদীদের দখলে! অস্ত্র হাতে দিনরাত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাওবাদীরা। খুনের পর খুন! এর মধ্যেই এলো পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচন। দিনটা ছিল ৩০ এপ্রিল। লোকসভা নির্বাচনে সেবার জঙ্গলমহলের সমস্ত বুথে ভোট গ্রহণ করা যায়নি। ভোট করতে হয়েছিল নিরাপদ জায়গায় একাধিক বুথে এবং ভোটারদের তুলে নিয়ে এসে। তুলনামূলক জনবহুল এলাকার স্কুলে একাধিক বুথ! ভোট গ্রহন কেন্দ্রে ভোটারের চেয়ে জওয়ান বেশি। ওইদিন লোকসভা ভোটের কাজ শেষ করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাহারায় ইভিএম নিয়ে বুথ থেকে ফিরছিলেন ভোট কর্মীরা। পথে মাওবাদীদের ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ! দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যু হয় বেলপাহাড়ির এড়গোদা গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্মী তথা ভোটের সেক্টর অফিসার প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

thebengalpost.net
মা নমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি- এস.মণ্ডল):

আর, তারপর থেকেই ভোট দেওয়া দূরের কথা, আর কোনও দিন বুথ মুখো হননি তাঁর বাবা-মা। বরং ভোট এলেই বুক দুরু দুরু করতে থাকে। ঠান্ডা হয়ে যায় গা-হাত-পা। ভোট দিন, ভোট দিন, মিছিল-মিটিংয়ের শব্দ শুনলে দৌড়ে ঘরে ঢুকে যান। শুনতে চাননা ভোটের কথা। ঠিক করেছেন জীবনে আর কোনও দিন ভোটও দেবেন না তাঁরা। তাঁরা পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী ব্লকের গোয়াপিয়াশালের বাসিন্দা নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসাদ ছিলেন তাঁদেরই তরতাজা ছেলে। ওই ঘটনার বছর তিনেক আগেই পঞ্চায়েত দপ্তরে চাকরি পেয়েছিলেন প্রসাদ। লোকসভা নির্বাচনই ছিল ভোটকর্মী হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ। ওইদিন (৩০ এপ্রিল) রাতেই মর্মান্তিক এই খবর পৌঁছয় পরিবারে। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে! বিনা মেঘে পর পর বজ্রপাতের মতোই ওই দিন আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটে ওই পরিবারে। ভোটের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় প্রসাদের জেড়তুতো ভাই, স্কুলের শিক্ষাকর্মী পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও! একই পরিবারে তরতাজা দু’জনের মৃত্যু! শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা পরিবারে। এই ঘটনার পর থেকে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত কোনও ভোটে ভোটদান করেন না প্রসাদের বাবা নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা নমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বর্তমানে, অশীতিপর নিত্যানন্দ বাবু কিডনির রোগে ভুগছেন। চলছে ডায়ালিসিস। প্রসাদের মা নমিতা দেবীর বয়স ৭৩ বছর। ভোটের কথা শুনলেই বিরক্তি! মিছিল, মিটিংয়ের শব্দ কানে এলেই দৌড়ে ঘরে ঢুকে যান। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে ভোটে কোনও আগ্রহ নেই তাঁদের। ডাই ইন হারনেসে (কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুর কারণে চাকরি) প্রসাদের চাকরি পেয়েছেন তাঁর স্ত্রী বনানী বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরে এক ব্লকে কর্মরত তিনি। সেদিনের তিন বছরের কন্যা আজ উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। মা-মেয়ে থাকেন মেদিনীপুরের এক সরকারি আবাসনে। প্রসাদের বাবা-মা থাকেন গোদাপিয়াশালের বাড়িতেই। প্রসাদের মা নমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সেদিনের পর থেকে আমরা আর কোনওদিন ভোট দিইনি। ভোট দিতে ইচ্ছেও করেনা। কেন ভোট দিতে যাবো। ভোটের কথা, মিছিল, মিটিং শুনলে বিরক্তি হয়। আমাদের এক ছেলে, এক মেয়ে ছিল। ভোটের দিন ছেলের মৃত্যু হলো। ভোট দিতে ইচ্ছে করবে? এই ঘটনার পর থেকে আর বুথ মুখো হই না। স্বামী অসুস্থ। ডায়ালিসিস চলছে। আমাদের আর কিছু ভালো লাগেনা। ওসব কথা আর আলোচনা করতেও চাই না। আমরা চাই, জীবনে যেন এরকম ঘটনা কারুর সঙ্গে না ঘটে!” শুধু প্রসাদের বাবা-মা নয়। এই ঘটনার পর থেকে কোনওদিন ভোট দেন না তাঁদের পরিবারের শুভাকাঙ্খী তথা নিকটাত্মীয় অশোক ঘোষও। অশকের বাড়ি উত্তর চব্বিশ পরগনার হালি শহরে। বিদ্যুৎ দপ্তরের কর্মী ছিলেন। কর্মসূত্রে ১৯৮৪ সাল থেকে শালবনীর গোদাপিয়াশালে থাকেন। প্রসাদকে খুব ভালো বাসতেন। প্রদাসও ভালো বাসতেন অশোক কাকু’কে। অশোকবাবু বলেন, “সেদিন ওকে (প্রসাদকে) আমিই বাইকে করে মেদিনীপুরে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। মৃত্যু খবরটাও প্রথম আমার কাছেই এসেছিল। চাকরির জয়েন করাতেও আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। শুধু ওর বাবা-মা নয়। ঘটনার পর থেকে আমিও কোনওদিন ভোট দিতে যাইনি। ঠিক করেছি জীবনে আর কখনও ভোটও দেবোও না!”

thebengalpost.net
অশোক ঘোষ (ছবি- এস. মণ্ডল):