দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৭ জুন: ১৯৩০ সালের ৬ ই জুন, ব্রিটিশ বাহিনীর গুলিতে কংসাবতী নদীর তীরে শহীদ হয়েছিলেন লবন সত্যাগ্রহে আন্দোলনরত ১৪ জন বিপ্লবী। অবিভক্ত মেদিনীপুরের, অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থানার চেঁচুয়ায় গত ৯১ বছর ধরে ১৪ জন শহীদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। রবিবারও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে চেঁচুয়ার শহীদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হল। অপরদিকে, শহীদদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে চেঁচুয়ায় আরও একটি স্মৃতি সৌধের উদ্বোধনও হল। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এবং শহীদ স্মৃতি রক্ষা কমিটির সহায়তায় এই স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয় বলে জানিয়েছেন দাসপুর- ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুনীল ভৌমিক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, দাসপুরের বিধায়ক মমতা ভূঁইয়া, জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্র, গোপাল চন্দ্র নন্দী প্রমুখ। শ্যামপদ বাবু বলেন, “দেশব্যাপী আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন, দাসপুরের চেঁচুয়াহাটে নৃশংস ব্রিটিশ বাহিনীর গুলিতে ১৪ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদ হয়েছিলেন। লবন সত্যাগ্রহীদের সেই অমর স্মৃতি স্মরণ করে প্রতিবছরের এদিনও (৬ জুন) শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হল।”
উল্লেখ্য যে, ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন সত্যাগ্রহীরা রূপনারায়ণ নদীর জোয়ার বাহিত নোনাজল থেকে লবন তৈরি এবং এই নদীর সঙ্গে সংযোগকারী পলাশপাই খালের তীরে চেঁচুয়া হাটে তা বিক্রয়ের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলতে থাকে। সত্যাগ্রহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি করেনি ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ। এ সত্ত্বেও স্বদেশী ও স্বেচ্ছাসেবক দল চেঁচুয়া হাটে লবন সহ স্বদেশী সামগ্রী ব্যবহার ও বিক্রয়ের অনুরোধ করতে থাকেন। পুলিশের কাছে এই খবর পৌঁছতে দেরি হয়নি। আইন অমান্য আন্দোলনকারীদের এই প্রচেষ্টা দমন করতে তৎপর হয়ে পুলিশ। ১৯৩০ এর ৩ জুন। দাসপুর থানার বড়বাবু ভোলানাথ ঘোষ সহকারী ও চার সিপাইকে নিয়ে হাটে পৌঁছে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। এই অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে পারেননি স্বাধীনতা সংগ্রামী স্থানীয় যুবক মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি ভোলা দারোগার নাম ধরে ডাকেন এবং একই বেঞ্চে তার পাশে বসে পড়েন। এতে ক্ষুব্ধ ভোলা দারোগা মৃগেন্দ্রনাথকে হাতের বেত দিয়ে আঘাত করে। মৃগেন্দ্রনাথ তা বরদাস্ত করেননি। বেত কেড়ে পাল্টা আঘাত করেন তিনি। এভাবে মৃগেন্দ্রনাথের রুখে দাঁড়ানোর পর উত্তেজিত জনতা ভোলা দারোগাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তার অর্ধদগ্ধ দেহ একটি পুকুরের পাড়ে মাটি চাপা দিয়ে কলাগাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ভোলা দারোগার সহকারীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে সেই রাত্রেই স্থানীয় একটি মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বাকি চার সেপাই কোনওক্রমে পালিয়ে যেতে পারে। ৩ রা জুনের এই ঘটনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন ঘটনার তদন্তে আসেন মেদিনীপুরের ডিএম মিস্টার পেডি, এডিএম আব্দুল করিম ও দাসপুরের নতুন দারোগা। চেঁচুয়া হাটে পুলিশ শিবির বসল। আশেপাশের গ্রামগুলিতে চলল ব্রিটিশ পুলিশের অবর্ণনীয় অত্যাচার। ঘর ছাড়তে বাধ্য হলেন অধিকাংশ পুরুষ। এরপরই, ৬ জুন ব্রিটিশ পুলিশের আদেশ অমান্য করে লবন সত্যাগ্রহীরা পলাশপাই খাল অতিক্রমে প্রস্তুত হলে, পুলিশের গুলিতে (১)চন্দ্রকান্ত মান্না(তেমোহানি), (২)অশ্বিনী দোলই(চকবোয়ালিয়া), (৩)ভৃগুরাম পাল(মোহনচক), (৪)শশীভূষন মাইতি(শায়লা), (৫)কালীপদ শাসমল(জালালপুর), (৬)দেবেন্দ্রনাথ নাড়া(জোটভগবান), (৭)সতীশচন্দ্র মিথ্যা(রাধাকান্তপুর), (৮)রামচন্দ্র পাড়ই(জোটঘনশ্যাম), (৯)নিতাই পড়িয়া(পাঁচবেড়িয়া), (১০)অবিনাশ দিণ্ডা(বাঁশখাল), (১১)সত্য বেরা (বাঁশখাল), (১২)শশী দিণ্ডা (গোবিন্দ নগর), (১৩)পূর্ণচন্দ্র সিংহ(খাড়রাধান্তপুর) ও (১৪)মোহন মাইতি(খাড়রাধান্তপুর)- এই ১৪ জন শহীদ হন। ১৪৫ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী আহত হন। শহীদদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে পলাশপাই খালের জল। সেই আত্মবলিদানের ইতিহাস রবিবার পুনরায় স্মরণ করা হল বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুরের সেই ঐতিহাসিক চেঁচুয়াহাটে।