দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২ ডিসেম্বর: এ এক কঠিন লড়াই। নাবালিকার গর্ভে নাকি তাঁর সন্তান! গ্রামের মোড়ল তথা শাসকদলের নেতাদের অঙ্গুলি হেলনে বিয়ে দেওয়া হল জোর করে। বিয়ের পর দিনই বেপাত্তা হলেন যুবক! গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করলেন শহরে। শুরু করলেন লড়াই। প্রায় ৫ বছর ধরে চললো দাঁতে দাঁত চাপা লড়াই। লড়াইয়ের মাঝখানেই হারাতে হয়েছে প্রিয়জনকে! তবুও, হার মানেননি পশ্চিম মেদিনীপুরের ইন্দ্রজিৎ। অবশেষে, ‘মেঘের আড়াল থেকে’ যুদ্ধ করেই যেন জয়ী হলেন ইন্দ্রজিৎ দে। ডিএনএ (DNA) টেস্ট প্রমাণ করলো নাবালিকার গর্ভে সত্যি সত্যিই ইন্দ্রজিতের সন্তান ছিলো না! প্রতারণার দায়ে সেদিনের নাবালিকা তথা বর্তমানে বছর ১৮’র তরুণী গ্রেফতার হলেন। এমনই ঘটনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর ব্লকের আনন্দপুর থানার অধীন আনন্দপুর এলাকার।

thebengalpost.net
শহরের ভাড়া বাড়িতে ইন্দ্রজিৎ :

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, “বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করে গর্ভবতী করেছে” এই অভিযোগে কলঙ্কিত করে, গ্রামে শালিসি সভা বসিয়ে ‘গর্ভবতী’ নাবালিকাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয় ইন্দ্রজিত দে নামে প্রতিবেশী এক যুবককে। অভিযোগ, ওই যুবক বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করে গর্ভবতী করেছিল নাবালিকাকে! অভিযোগ অস্বীকার করেন আনন্দপুর এলাকার বছর ২২-এর যুবক ইন্দ্রজিৎ দে। মেনে নিতে পারেননি ওই বিয়ে। জোর করে বিয়ে দেওয়ায়, পরের দিনই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান অন্যত্র। আদালতে মামলা করেন নাবালিকার পরিবারের বিরুদ্ধে। মাস পাঁচেক পরে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় বছর ১৩-১৪’র নাবালিকা। আদালতে চলে আইনি লড়াই। গ্রামে শাসক ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে চলে ইন্দ্রজিতের পরিবারের লড়াই। বয়কট করা হয় তাঁর পরিবারকে। রহস্য মৃত্যু হয় তাঁর কাকার! এদিকে, আদালতে ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানান ইন্দ্রজিৎ। প্রায় ৩-৪ বছর পর ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমানিত হয় নাবালিকার জন্ম দেওয়া ‘কন্যাসন্তান’ ইন্দ্রজিতের ঔরসজাত নয়! মিথ্যে অভিযোগ করায় নাবালিকা, বর্তমানে তরুণীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চলতি সপ্তাহের বুধবার তরুণীকে আদালতে তোলা হয়। শর্ত সাপক্ষে বিচারক তরুণীকে জামিন দেন। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, “২০১৭ সালের একটি ঘটনায় এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। এর বেশি কিছু বলা যাবেনা।”

ঘটনার সূত্রপাত, ২০১৭ সালে। আনন্দপুর থানার আনন্দপুর সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ইন্দ্রজিত দে শুক্রবার ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, “গ্রামের এক গর্ভবতী নাবালিকাকে বিয়ে করার জন্য স্থানীয় তৃনমূল নেতাদের মদতে শালিসি সভা বসানো হয় কয়েকবার। এক রাতে স্থানীয় তৃনমূল নেতা তপন পণ্ডিত, শচীনন্দন বারিক, আশিস বারিক’দের নেতৃত্বে আমার পরিবারের লোকজনকে বেঁধে রেখে আমাকে মেয়ের বাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিয়ে দেয় ওই মেয়ের সঙ্গে। আমার আপত্তি থাকলেও বিয়ে করতে বাধ্য করা হয় আমাকে। যে ঘটনা সত্য নয় তা আমি মেনে নিতে পারিনি। বিয়ের পরদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপন করি। ঘটনার কথা জানিয়ে আদালতে মামলা করি। শাসকদলের নেতাদের নির্দেশে আমার পরিবারের চাষবাস সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। চাপ পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় আমি যাতে ওই মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিই। আমি ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানাই। আদালত ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যেই ২০১৮ সালে তৎকালীন কেশপুর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি সঞ্জয় পানের নেতৃত্বে তাঁর দলবল এসে আমাদের পরিবারের চাষবাস বন্ধ করে দেয়। তিন-চারদিন পর আমার কাকা তাপস দে (৫২)-র ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় বাড়ির কিছুটা দূরে একটি গাছে। আনন্দপুর থানায় আমরা তৃনমূল নেতা সঞ্জয় পান সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করি। শাসক দলের নেতাদের নাম থাকায় পুলিশ কিছুই করেনি।” জানা গিয়েছে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ডিএনএ রিপোর্ট আসে। রিপোর্ট থেকে ইন্দ্রজিৎ-রা জানতে পারেন, নাবালিকার জন্ম দেওয়া কন্যা সন্তান ইন্দ্রজিৎ এর নয়। চলতে থাকে বিচার পর্ব। ইন্দ্রজিতের আইনজীবী শমিক বন্দ্যোপাধায় বলেন, “আদালত পুনঃরায় তদন্তের নির্দেশ দেন পুলিশকে। পুলিশ তদন্ত করে আদালতে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি ধরা পড়ে। যে কারণেই হোক এক্ষেত্রে মেয়েকে আসামী করেনি পুলিশ। আদালত ফের তদন্তের নির্দেশ দেন নভেম্বরের ১০ নভেম্বর। বুধবার পুলিশ ওই মেয়েকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পেশ করে। বিচারক শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেন।” তিনি এও বলেন, “আশ্চর্যের বিষয়, এক্ষেত্রে পুলিশ মেয়েটিকে হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানায়নি। মেয়েটির সন্তানের বাবা কে? তা একমাত্র বলতে পারবে তার মা, অর্থাৎ মেয়েটিই। পুলিশ কী তদন্ত করে দেখা যাক, নাহলে ফের জামিন নাকচের আবেদন জানাবো আদালতে।” যুদ্ধ জয়ী ইন্দ্রজিৎ বলেন, “প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমার লড়াই চলবে!”

thebengalpost.net
কঠিন লড়াইয়ে জয়ী: