দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১১ জুন: সম্প্রতি মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন খানের ‘পদত্যাগ’- এর দাবি তুলে পৌরসভার সামনে বিক্ষোভ অবস্থানে বসেছিলেন তৃণমূলেরই ১০ জন কাউন্সিলর। ছিলেন দলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা-র স্ত্রী মৌসুমী হাজরাও। জুন মালিয়া ‘ঘনিষ্ঠ’ সৌমেন খানের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভের খবর পৌঁছে গিয়েছিল দলনেত্রীর কাছেও। ভালোভাবে নেননি তিনি। বুধবার বিকেলে কালীঘাটের সাংগঠনিক বৈঠকে এজন্য দলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা-কে ভর্ৎসনা করেন ‘দিদি’ তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনটাই জানা গেছে বৈঠকে উপস্থিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একাধিক নেতার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার নির্দেশ দেন তিনি। এরপরই সুজয় বলতে ওঠেন! প্রথমে ‘দিদি’ আপত্তি জানালেও, সুজয়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে শোনেন। তারপরই, সুজয় যা বলেন, তাতে নাকি বৈঠকে উপস্থিত অনেক পোড়খাওয়া নেতারও রীতিমত ‘ভিরমি’ খাওয়ার পরিস্থিতি হয়!
মেদিনীপুর পৌরসভা এবং বিধায়ক জুন মালিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক ‘অনুযোগ’-কে সংক্ষিপ্ত করে সুজয় নাকি বলেন, “দিদি, আমাকে কেউ ‘সারমেয়’ বলবে, আর আমাকেই সুসম্পর্ক রেখে চলতে হবে এটা কিভাবে হয়? দিদি, দলটা আমি প্রথম থেকেই আত্মসম্মান নিয়ে করি। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়। যদি দলের মনে হয়, আমার জন্য দলের এতটুকুও ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে; এই মুহূর্তে আমি পদত্যাগ করে চলে যাব। তবে, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে চলতে পারবো না।” এরপরই সুজয় নিজের ওয়ার্ডের (২২নং ওয়ার্ডে) একটি ঘটনা তুলে ধরে মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন খানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আনেন। এও বলেন, ওই ওয়ার্ডে তাঁর স্ত্রী রেকর্ড ভোটে (প্রায় সাড়ে তিন হাজার) জয়ী হয়েছেন। তা সত্ত্বেও হাইকোর্টের নির্দেশে অরবিন্দনগর মাঠের পাশে রাস্তা তৈরিকে কেন্দ্র করে মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানের ‘একতরফা’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিরুদ্ধেও অনুযোগ করেন সুজয়। এরপর, মেদিনীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন খান-কে দলনেত্রী প্রশাসনিক বিষয়ে কিছু স্পষ্ট নির্দেশ দেন এবং সুজয়ের সঙ্গে মিলেমিশে চলার পরামর্শ দেন। তবে, বৈঠকে সুজয় যেভাবে দিদির সামনে দৃপ্ত কন্ঠে ‘আত্মসম্মান’ এর কথা বলেন এবং প্রয়োজনে ‘পদত্যাগ’-র কথাও বলেন, তাতেই জেলার নেতা- মন্ত্রীদের চক্ষু চড়ক গাছ হয়েছে! শেষ কবে দিদির (দলনেত্রীর) আক্রমণের সামনে তৃণমূলের কোনো নেতাকে এভাবে ‘আত্মপ্রত্যয়ী কন্ঠে’ প্রতিক্রিয়া দিতে দেখেছেন, গোটা রাস্তা নাকি সেটাই তাঁরা ভাবতে ভাবতে এসেছেন!
বৈঠকে উপস্থিত দলের এক তরুণ নেতা তথা জনপ্রতিনিধি শোনালেন, “সুজয় দা-কে ভালোবাসতাম। আজ থেকে ফ্যান হয়ে গেলাম। পুরো রিকি পন্টিং এর ঢঙে ‘অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ খেললেন দিদির সামনে!” এক পোড়খাওয়া নেতা আবার বললেন, “বাপরে! দিদি যেভাবে শুরু করেছিলেন, আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর সুজয় যা বললো, দিদিও কয়েক সেকেন্ড চুপ করে গিয়েছিলেন!” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বছরখানেক আগে দলীয় একটি কর্মসূচি শেষে সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের উত্তরে মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়া জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা কিংবা শহর সভাপতি বিশ্বনাথ পাণ্ডবের নাম না নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি কি গলায় চেন দিয়ে টেনে আনব?” তাঁর কর্মসূচিতে সুজয় কিংবা বিশ্বনাথের উপস্থিত না থাকা নিয়েই প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। তবে, ঘাটাল লোকসভায় পুনরায় দেব (দীপক অধিকারী)-কেই যে প্রার্থী হিসেবে চাইছেন তৃণমূল সুপ্রিমো; তা স্পষ্ট করে দেওয়ার সাথে সাথেই জুনকে নিয়েও এদিন বার্তা দিয়েছেন মমতা। বলেছেন, “জুন খুব ভাল কাজ করছে। ওর জন্য আমি আরও ভালো কিছু ভেবে রেখেছি!” বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতার মতে, মেদিনীপুর লোকসভা আসনে সম্ভবত বিজেপি-র সম্ভাব্য প্রার্থী দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়াকেই চাইছেন মমতা।
অন্যদিকে, ঘাটালের প্রাক্তন বিধায়ক তথা বর্তমানে সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান শঙ্কর দোলই-কে ভর্ৎসনা করে মমতা বলেছেন, “দেবকে নাকি তোমরা কাজ করতে দিচ্ছ না ভালো করে? দেবের মতো সাংসদ দলের সম্পদ। তোমাদের জন্যই ও আর ঘাটালে দাঁড়াতে চাইছে না! এটা আমি মেনে নেব না।” দেবকে পাশে বসিয়ে ‘দিদি’ এদিন এভাবেই বার্তা দিয়েছেন বলে জানান বৈঠকে উপস্থিত ঘাটালের একাধিক নেতা। বৈঠকে খড়্গপুর গ্রামীণের বিধায়ক দীনেন রায়, দলের রাজ্য সম্পাদক প্রদ্যোৎ ঘোষ ও আশিস চক্রবর্তী (নান্টি)-র মতো পুরানো নেতাদের আরো ‘সক্রিয়’ হওয়ার বার্তা দিয়েছেন মমতা। বরাবরের মতোই ভরসা রেখেছেন পোড়খাওয়া নেতা তথা জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভুঁইয়ার উপর। দুই মেদিনীপুর জেলাই তাঁকে দেখার কথা বলছেন মমতা। অন্যদিকে, মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক ও MKDA চেয়ারম্যান দীনেন রায়কে বলেছেন, “দীনেন তোমার মতো পুরানো নেতারা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম মেদিনীপুরে এত কোন্দল তৈরি হচ্ছে কেন? প্রদ্যোৎ (ঘোষ), নান্টি (আশিস চক্রবর্তী), বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে পুরোটা দেখে নেবে।” তবে, দলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি ও প্রাক্তন আহ্বায়ক তথা পিংলার বিধায়ক ও জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি অজিত মাইতি-কে এদিন খড়্গপুর ২নং ও পিংলা-র ব্লক সভাপতিদের সঙ্গে ‘কোন্দল’ তৈরি করার জন্য কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষে যদিও বলেছেন, “তোমরা সিনিয়র নেতা। একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবে।” কেশিয়াড়ির ব্লক সভাপতি শ্রীনাথ হেমব্রমকে অবিলম্বে সরানোর নির্দেশও এদিন দিয়েছেন নেত্রী। তবে, এদিন সবথেকে বেশি তিনি জোর দিয়েছেন লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের গোষ্ঠী কোন্দল অবিলম্বে মিটিয়ে ফেলার দিকেই!