দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৭ জুন: “খড়্গপুরে গুলি চালিয়ে দিয়ে চলে গেল! পুলিশও আমি চেঞ্জ করতে পারছিনা। এখন তো বছরে প্রতিদিনই প্রায় ইলেকশন।” ‘রেল শহর’ খড়্গপুরের শুট-আউট কাণ্ডে বৃহস্পতিবার ‘নবান্ন’ থেকে ঠিক এমনই মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (২৫ জুন) ভর দুপুরে খড়্গপুর শহরের ১৫-নং ওয়ার্ডের মথুরাকাটি (জয় হিন্দ নগরে) এলাকায় তৃণমূল কার্যালয়ের ঠিক পাশেই শান-বাঁধানো গাছের তলায় বসে থাকা বেশ কয়েকজন যুবককে (বা, তৃণমূল কর্মীকে) লক্ষ্য করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় স্কুটিতে করে আসা তিন দুষ্কৃতী। বাকিরা পালিয়ে গেলেও, পায়ে পুরানো আঘাত থাকার কারণে ছুটতে না পেরে গুলিবিদ্ধ হন বি. সন্তোষ কুমার। নিজেকে তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করেছিলেন সন্তোষ। যদিও, এই ঘটনায় সন্তোষ নন, দুষ্কৃতীদের ‘টার্গেট’ নাকি ছিলেন ওই পার্টি অফিসের মূল নিয়ন্ত্রক তথা শ্রীনু-হত্যায় রামবাবুদের সঙ্গেই ‘বেকসুর খালাস’ হওয়া সঞ্জয় প্রসাদ!

thebengalpost.net
মঙ্গলবারের শুট-আউটের CCTV ফুটেজ:

মঙ্গলবার গভীর রাতেই গুলি কান্ডে ভিকি পিল্লাই এবং উত্তম কোন্ডাল নামে দুই দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছে খড়্গপুর টাউন থানার পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে শুট-আউটের সময় ব্যবহৃত স্কুটি সহ দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র (বন্দুক), বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি এবং কয়েক লক্ষ টাকা। আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে খড়্গপুর শহরের একাধিক কুখ্যাত মাফিয়া তথা গ্যাংস্টার-কে। সূত্রের খবর, সেই তালিকায় যেমন আছে শ্রীনু (২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি ১৮ নং ওয়ার্ডের দলীয় কার্যালয়ে খুন হয়েছিলেন ‘কুখ্যাত’ রেল মাফিয়া শ্রীনু নাইডু) হত্যাকাণ্ডে ‘বেকসুর খালাস’ হওয়া সঞ্জয় প্রসাদ (তৃণমূল কর্মী সঞ্জয়ের কার্যালয়ের পাশেই ঘটে শুট-আউটের ঘটনা), শঙ্কর রাও, কৃষ্ণা রাও-রা; ঠিক তেমনই আছে তার্কি রাও (তারকেশ্বর রাও), দীনেশ কোন্ডালদের মতো দুষ্কৃতীরাও! লক্ষ্য একটাই শুট-আউট কান্ডের ‘মাস্টার মাইন্ড’ বা মূল ষড়যন্ত্রীকে যত দ্রুত সম্ভব পাকড়াও করা! পুলিশ সূত্রেই জানা গেছে, এই শুট-আউট কান্ডের ‘মাস্টার মাইন্ড’ হলো রামবাবু, শ্রীনু নাইডু পরবর্তী রেলশহরের ‘নতুন’ ত্রাস শুভম সুনার ওরফে বিক্রম। শুট-আউট কান্ডের পর থেকেই উধাও হয়ে গেছে সে। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে বছরের প্রথম দিনই (১ জুলাই) ভর সন্ধ্যায় ১৫-নং ওয়ার্ডের মথুরাকাটি এলাকায় তৃণমূল কর্মী তথা প্রমোটার অর্জুন সোনকারকে গুলি করে খুন করার ঘটনায় প্রথমবার সামনে আসে ‘উঠতি মাফিয়া’ শুভমের নাম! ঠিক পরের বছরই, ২০২২ সালের ২৭ জুন রাত্রি ১০টা নাগাদ তৃণমূল নেতা প্রদীপ সরকারের কার্যালয় থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ওল্ড সেটেলমেন্টের মাতা মন্দিরের কাছে শুট-আউটে খুন হন আরেক তৃণমূল কর্মী প্রসাদ রাও তরফে ভেঙ্কট! দুটি ঘটনাতেই মূল অভিযুক্ত শুভম-কে জেল খাটতে হয়। তবে, কোনও এক রহস্যজনক কারণে দু’দুটি খুনের মূল অভিযুক্ত হয়েও জামিন পেয়ে যায় বছর ৩৫-র শুভম সুনার। রেল শহরের বাসিন্দা থেকে বিরোধী দলের নেতাদের অভিযোগ, রেল শহর খড়্গপুরের তাবড় সব তৃণমূল নেতার ‘হাত’ শুভমের মাথায় থাকার কারণেই জামিন পেয়ে যায় ছাঁট লোহার অন্যতম কারবারী তথা উঠতি ‘গ্যাংস্টার’ শুভম! শুভম খড়্গপুর শহরের এক শ্রমিক নেতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলেও অভিযোগ। এক সময় আরও এক বড় নেতার ছত্রছায়াতেও নাকি ছিল শুভম।

thebengalpost.net
ধৃত দুই দুষ্কৃতী:

২০২৩ সালের শুরুর দিকে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শুভম নাকি আরও ‘বেপরোয়া’ হয়ে ওঠে। এদিকে, ২০২৩ সালের জুন মাসে (২৭ জুন) বাসব রামবাবু সহ শঙ্কর রাও, সঞ্জয় প্রসাদ-রাও ‘বেকসুর খালাস’ হয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন! তার ঠিক কয়েকদিন পরেই, ১১ জুলাই (২০২৩) রাত্রি ১০টা নাগাদ ‘রেল শহর’ খড়্গপুরের (৯ ও ১৬ নং ওয়ার্ডের মাঝামাঝি) গাঁটরপাড়া এলাকায় এক দুষ্কৃতীর ছোঁড়া গুলিতে মৃত্যু হয় সঞ্জীব যাদব ওরফে জিলা ছোটু (৩১) নামে এক যুবকের। সেই ঘটনায় যদিও শুভম নয়, সোনু মিশ্র নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে, তখন থেকেই নাকি জেল-মুক্ত সঞ্জয়, শঙ্কর, কৃষ্ণাদের বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে নানা ‘ষড়যন্ত্র’ করছিল রেল শহরের নতুন ‘ত্রাস’ শুভম। সঞ্জয়, শঙ্কর-রা যাতে নিজেদের এলাকায় আর মাথা তুলতে না পারে, সেজন্যই শাসকদলের একাংশ নেতার ছত্রছায়ায় থেকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল শুভম। ছাঁট লোহার কারবার ছাড়াও খুন, হুমকি, তোলাবাজি সবই চালিয়ে যাচ্ছিল শুভম। অজ্ঞাত কারণে পুলিশও তার টিকি ছোঁয়ার চেষ্টা করেনি! ফলে, নিজেকে রেলশহরের নতুন ‘ডন’ মনে করে শুভম হুমকি, তোলাবাজি, ছাঁট লোহার কারবার করে একচ্ছত্রাধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে গেছে! আর যখনই তাতে বাধা পেয়েছে, গর্জে উঠেছে ‘গ্যাংস্টার’ শুভম। কখনও (২০২৪-র ১৯ মার্চ) ১৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বান্তা মুরলিধর রাওয়ের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে তাঁর স্ত্রী-র গয়না লুট করার ঘটনায় তার নাম জড়িয়েছে। আবার কখনও (২০২৪-র ৮ এপ্রিল) রামবাবু-ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন কাউন্সিলর অঞ্জনা সাঁকরে-র স্বামী রঞ্জিত কুমার সাঁকরে-র উপর হামলা চালানোর ঘটনাতেও উঠে এসেছে শুভমেরই নাম! আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল গত ২১ এপ্রিল (২০২৪) তৃণমূলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় খড়্গপুরের একটি হোটেল দলীয় বৈঠক সেরে ফিরে যাওয়ার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই, বিকেল ৫-টা নাগাদ আয়মা সংলগ্ন রেলের ওয়াগন শপ এলাকায় ছাঁট লোহার ব্যবসায়ী নারায়ণ রাও গুলিবিদ্ধ হন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনায় সোমু রাজভর নামে এক যুবক গ্রেফতার হলেও, এই ঘটনার পিছনেও নাকি মদত ছিল শুভমেরই! সম্প্রতি, রেলের ঠিকাদার ডি. মহেশ তাঁর কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা তোলা আদায়ের অভিযোগে FIR করেছেন শুভম সহ তাঁর অন্যতম সাগরেদ তারকেশ্বর রাও (তার্কি), দীনেশ কোন্ডাল, ডি. সন্তোষ রাও, বি.রোহিতদের নামে। সেই FIR-র ভিত্তিতে ‘পলাতক’ শুভম বাদে বাকিদের মঙ্গলবার রাতেই আটক করেছে খড়্গপুর টাউন থানার পুলিশ। এদিকে, তৃণমূল কর্মী তথা অন্যতম ‘গ্যাংস্টার’ সঞ্জয় প্রসাদের কার্যালয়ের বাইরে গুলি চালানোর ঘটনাতেও মূল অভিযুক্ত শুভম-ই! মঙ্গলবারের (২৫ জুন) ঘটনা প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) মুখ্যমন্ত্রীর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, “গুলি চালিয়ে দিয়ে চলে গেল…নির্বাচনের কারণে পুলিশকে আমি চেঞ্জ করতেও পারছিনা!” বলাই বাহুল্য ‘চাপ’ বাড়ছে পশ্চিম মেদিনীপুরের SP ধৃতিমান সরকারের উপরও। শুভম-কে তাই হন্যে হয়ে খুঁজছে জেলা পুলিশ!

thebengalpost.net
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়: