দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২ জুলাই: হঠাৎই এক সহপাঠী তথা সহ-আবাসিক অসুস্থ হয়ে যায়। হোস্টেল সুপার সহ অন্যান্য শিক্ষক ও স্থানীয়দের তৎপরতায় রাতেই তাকে ভর্তি করা হয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। ওই ছাত্রকে ভর্তি করে ফিরতে ফিরতে হোস্টেল সুপার সহ কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষকদের ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় (রাত্রি প্রায় সাড়ে ১২টা)। আর এর মধ্যেই রীতিমত ‘তাণ্ডব’ শুরু হয়ে যায় ছাত্রাবাসে। যা দেখে কার্যত চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় হোস্টেল সুপার, শিক্ষক সহ অন্যান্য ছাত্রদের! সপ্তম, অষ্টম আর নবম শ্রেণীর ৭-৮ জন ছাত্র ‘ঠাকুর ভর করেছে’ দাবি করে একপ্রকার ‘তাণ্ডব-লীলা’ চালায়। কখনও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভান করে আবার কখনও বড় বড় চোখ করে, গোল গোল করে মাথা ঘোরাতে থাকে। যা দেখে বাকি ছাত্ররা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে! দিনকয়েক আগে অদ্ভুত এই কাণ্ডটি ঘটে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জঙ্গল অধ্যুষিত শালবনী ব্লকের ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে।

thebengalpost.net
বিজ্ঞান মঞ্চের সচেতনতা শিবির:

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, দিন পনেরো আগে রাত্রি ৮-টা নাগাদ ছাত্রাবাসের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রের গ্যাস-অম্বল থেকে সামান্য খিঁচুনির মতো হয়! এরপরই, স্থানীয় কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী, প্রাক্তন ছাত্রদের সহায়তায় হোস্টেল সুপার সহ দু’একজন শিক্ষক ও সিনিয়র ছাত্ররা মিলে অসুস্থ ওই ছাত্রকে নিয়ে গিয়ে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করেন। খবর দেওয়া হয় তার পরিবারেও। পরিবারের তরফে জানানো হয়, খুব ছোট বয়সেও ওই ছাত্রের একবার খিঁচুনির মতো হয়েছিল। এদিকে, ওই ছাত্রকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে, ছাত্রাবাসে ফিরেই শিক্ষক ও স্থানীয়রা দেখেন, ততক্ষণে রীতিমতো তান্ডব চলছে হোস্টেল জুড়ে! সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ৭-৮ জন ছাত্রের দাবি, অসুস্থ ওই ছাত্রকে যে ‘ঠাকুর’ ভর করেছে, তাদেরও সেই ‘ঠাকুর’-ই ভর করেছে! এভাবেই ভোর সাড়ে ৩টা অবধি ‘তাণ্ডব-লীলা’ চালিয়ে যায় ওই ছাত্ররা। এরপর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি প্রতিনিধি এবং এলাকার শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কিছু মানুষজনের চেষ্টায় ভোর সাড়ে তিনটা নাগাদ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু, হোস্টেলের পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক পিছু তাড়া করে বেড়ায়!

পরদিন সকালেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ড. অমিতেশ চৌধুরী সহ অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং স্কুল পরিচালন সমিতির উদ্যোগে ‘ভর করা’ ওই ছাত্রদের অভিভাবকদের ডেকে পাঠানো হয় এবং বোঝানো হয়। একইসঙ্গে, তাদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ছাত্রদের অভিভাবকদেরও খবর দেওয়া হয়। বিভিন্নভাবে ওই ছাত্রদের বোঝানো হয় বা কাউন্সেলিং করা হয়। ইতিমধ্যে অসুস্থ ছাত্রটি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে। কিন্তু, ছাত্রাবাসের ছাত্রদের মন থেকে ভয় ও আতঙ্ক পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়নি! এই পরিস্থিতিতেই গত সপ্তাহে বিজ্ঞান মঞ্চের দ্বারস্থ হয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। শনিবার (২৯ জুন) বিজ্ঞান মঞ্চের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শাখার নেতৃত্ব ড.বাবুলাল শাসমল, নন্দদুলাল ভট্টাচার্য, বিধান পড়িয়া প্রমুখের উপস্থিতিতে সচেতনতামূলক নাটক ও বক্তব্য পরিবেশিত হয়। ছাত্র ও অভিভাবক অভিভাবিকাদের সামগ্রিক অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। কুসংস্কারকে দূরে সরিয়ে রেখে, যুক্তিনির্ভর মুক্ত চিন্তা নিয়ে আগামী দিনে পথ চলার বার্তা দেওয়া হয়। অভিভাবক ও পড়ুয়ারা সেই সঙ্কল্পই গ্রহণ করেন। বিদ্যালয়ের তরফে প্রধান শিক্ষক ড. অমিতেশ চৌধুরী বিজ্ঞান মঞ্চের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। মঙ্গলবার (২ জুলাই) ড. চৌধুরী বলেন, “পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আতঙ্কিত ছাত্রদের কয়েকজন বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারাও ধীরে ধীরে হোস্টেলে ফিরে আসছে। ওদের বোঝানো গেছে, পুরোটাই গুজব, ভণ্ডামি বা কুসংস্কার। বছর ছয়েক আগেও এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময়ও আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। আসলে পিছিয়ে পড়া, আদিবাসী অধ্যুষিত, প্রান্তিক এলাকার ছাত্রদের নিয়েই আমাদের চলতে হয়! স্বাভাবিকভাবেই নানা গুজব বা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে একজন-দু’জন এই ধরনের কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। আর তাতেই বাকিরা প্রভাবিত হয়। যাই হোক, সারা বছর ধরেই আমাদের বিদ্যালয়ে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আগামীদিনে তা আরও বাড়ানো হবে।”

thebengalpost.net
ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকরা: