দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৬ আগস্ট: দলীয় ‘নির্দেশ’ উপেক্ষা করে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হতে চেয়েছিলেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি ব্লকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ফটিক রঞ্জন পাহাড়ির সেই চেষ্টা ‘সফল’ হয়নি। এরপরই, দলের বিজয়ী ২৩ জন পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের মধ্যে কার্তিক পালুই সহ ১৪ জনকে সঙ্গে নিয়ে (ফটিক সহ ১৫ জন) কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন খোদ জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, বিডিও এবং থানার আই.সি-র বিরুদ্ধে। গত ১৪ আগস্ট কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করার পরই, ১৫ আগস্ট ফটিক-কে অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘সাসপেন্ড’ করে জেলা তৃণমূল। আর, গতকাল অর্থাৎ শুক্রবার (২৫ আগস্ট) গভীর রাতে পুরানো একটি খুনের মামলায় সেই ফটিককেই গ্রেপ্তার করে CID। ২০১৭’র শেষের দিকে তৃণমূলের তৎকালীন অঞ্চল সভাপতি ঝাড়েশ্বর সাঁতরা ওরফে মৃত্যুঞ্জয় সাঁতরা-কে খুনের ঘটনায় ‘বিদ্রোহী’ ও ‘বহিষ্কৃত’ তৃণমূল নেতা ফটিক পাহাড়িকে পূর্ব মেদিনীপুরের দীঘা থেকে সিআইডি-র একটি দল গ্রেপ্তার করে বলে পুলিশ ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে। ফটিক ছাড়াও গ্রেফতার করা হয়েছে কার্তিক পালুই-কে। এই কার্তিক-কেই ‘মূল মামলাকারী’ করে রাজ্য প্রশাসনের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের বেঞ্চে মামলা দায়ের করেছিলেন ফটিক। জেলা পুলিশ এবং জেলা তৃণমূলের একটি সূত্রে জানা যায়, ওই এলাকায় তৃণমূলের তৎকালীন জনপ্রিয় যুব নেতা ঝাড়েশ্বর-কে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় ফটিকের সাথে কার্তিকও ছিল অন্যতম অভিযুক্ত। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে, তাঁদের দু’জনকেই অর্থাৎ তৃণমূলের ‘বিদ্রোহী’ দুই পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যকে শুক্রবার রাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, ১৫ জন মামলাকারীর মধ্যে অন্যতম তথা ফটিক ঘনিষ্ঠ আরেক পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য রামপদ সিং- কেও গ্রেপ্তার করেছে জেলা পুলিশ। পেশায় শিক্ষক রামপদ-র বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারণার অভিযোগে, শনিবার তাঁকে জেলা পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। শনিবার ধৃত ৩ জনকেই আদালতে তোলা হবে বলে জানা গেছে।

thebengalpost.net
ফটিক রঞ্জন পাহাড়ি :

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের শেষের দিকে খুন হন ঝাড়েশ্বর ওরফে মৃত্যুঞ্জয়। কেশিয়াড়ির ডাডরা গ্রামের ওই যুবক দলীয় বৈঠকে যোগ দিতে নছিপুরে গিয়েছিলেন। রাতে মোটরবাইকে করে বাড়ি ফিরছিলেন। ভসরাঘাটে ঢোকার ঠিক আগে তাঁর উপর চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা। প্রথমে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তির ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। পায়ে তির লেগে বাইক থেকে পড়ে যাওয়ার পরই, ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁকে কোপানো হয়। উপড়ে নেওয়া হয় চোখ! ওই খুনের পর রাস্তার ধারে দেহ ফেলে রেখে চলে যায় অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা। ওই সময় বিজেপি-র বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনে তৃণমূল। পরে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে মামলার তদন্তভার যায় সিআইডি-র হাতে। তারপরই প্রধান অভিযুক্ত হিসাবে উঠে আসে ফটিকের নাম। অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে কার্তিকের নামও সিআইডি’র FIR- এ ছিল বলে সূত্রের খবর। কেশিয়াড়ি ব্লক তৃণমূল এবং জেলা তৃণমূলের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সুবর্ণরেখা নদীর বালি অবৈধভাবে উত্তোলন করার কাজে ফটিক-দের প্রত্যক্ষ মদত নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন যুব নেতা ঝাড়েশ্বর সহ অনেকেই। সেই ‘বালি’ মাফিয়াগিরিতে ঝাড়েশ্বর ‘বাধা’ হয়ে দাঁড়ানোর কারণেই, তাঁকে খুন হতে হয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যদিও, যে তদন্ত এতদিন ঢিমে তালে চলছিল, হঠাৎ করেই তাতে সিআইডি সক্রিয় হয়ে ঠিক ‘এই সময়ই’ (বোর্ড গঠনের কয়েকদিন আগে) ফটিকদের গ্রেপ্তার করাতে বিরোধীরা তৃণমূল দল এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে, ‘শিক্ষক নেতা’ রামপদ সিং চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। তাঁকেও প্রতারণা মামলায় শনিবার জেলা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা গেছে।

thebengalpost.net
গ্রেপ্তার করল সিআইডি :

এ প্রসঙ্গে এও উল্লেখ্য যে, ২৩-৪ ব্যবধানে কেশিয়াড়ি পঞ্চায়েত সমিতি দখল করলেও, প্রবল গোষ্ঠী-কোন্দলের কারণে গত ১০ আগস্ট সেখানে বোর্ড গঠন করতে পারেনি তৃণমূল। দলের তরফে কেশিয়াড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হিসেবে উত্তম শিটের নাম প্রস্তাব করা হলেও, সেখানকার দাপুটে নেতা ফটিক রঞ্জন পাহাড়ি ও তাঁর অনুগামীরা বেঁকে বসেন। ফটিক নিজে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হতে চেয়ে ভোটাভুটির দাবি করেন। এরপরই, গত ১০ আগস্ট বোর্ড গঠন ভেস্তে যায়। গত ১৫ আগস্ট ফটিককে সাসপেন্ড করে জেলা তৃণমূল। অন্যদিকে, ফটিক রঞ্জন পাহাড়ি তাঁর সঙ্গে আরও ১৪ জন বিজয়ী পঞ্চায়েত সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। খোদ পশ্চিম মেদিনীপুরের ডিএম, এসপি থেকে শুরু করে স্থানীয় BDO, IC সহ রাজ্য সরকারের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই পরিস্থিতিতে কেশিয়াড়িতে এবারও তৃণমূলের বোর্ড গঠন ঘিরে একপ্রকার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়! অন্যদিকে, আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পুনরায় কেশিয়াড়িতে বোর্ড গঠনের বা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নির্বাচনের দিন ধার্য করেছে প্রশাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, বোর্ড গঠনের জন্য তৃণমূলের প্রয়োজন অন্তত ১৪ জন পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার (২৫ আগস্ট) গভীর রাতে বিজেপির ৪ জন জয়ী সদস্যের মধ্যে অভিজিৎ দাস ও ঝর্ণা সিট নামে দু’জন যোগ দেন তৃণমূলে। বৃষ্টি তথা আবহাওয়ার ‘প্রতিকূলতা’-কে উপেক্ষা করেই মেদিনীপুরে জেলা তৃণমূলের কার্যালয়ে এসে, জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা-র হাত থেকে তাঁরা গতকাল রাত্রি সাড়ে ১১টা নাগাদ তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নেন। ‘বিদ্রোহী’ ও ‘বহিষ্কৃত’ নেতা ফটিক পাহাড়ির শিবিরে থাকা ১০-১২ জনও নাকি ইতিমধ্যেই নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটেছেন! তাঁরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে, দলের মনোনীত উত্তম শিট-কেই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হিসেবে মেনে নিয়েছেন বলে জেলা তৃণমূল সূত্রে খবর। তৃণমূলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা জানান, “ওই দিন একটা সমস্যা হয়েছিল। তাই, বোর্ড গঠন বাতিল করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে, সমস্যা সৃষ্টিকারী ওই নেতাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর নির্বিঘ্নে আমরা ভোট গঠন করব। উত্তম শিট-ই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যরাই তাঁকে সমর্থন জানাবেন।” আর, তার মধ্যেই গ্রেফতার করা হলো ফটিক রঞ্জন পাহাড়ি, কার্তিক পালুই এবং রামপদ সিং-কে। এই বিষয়ে জেলা সভাপতি সুজয় বলেন, “আইন আইনের পথে চলছে। তদন্ত চালাচ্ছিল সিআইডি। অভিযুক্ত হিসেবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর সঙ্গে দলের বা সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কোন সম্পর্ক নেই।” যদিও, জেলা বিজেপির মুখপাত্র অরূপ দাস বলেন, “এই সমস্ত নোংরা বিষয় নিয়ে আমাদের বলার কিছুই নেই। তৃণমূল মানেই চোর, মাফিয়া, খুনি, সন্ত্রাসবাদীদের দল। আর, পুলিশ কিংবা সিআইডি- তো তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রীর কেনা ‘গোলাম’ ছাড়া আর কিছুই নয়! তিনি যা নির্দেশ দেবেন, পুলিশও তাই করবে। ওরা (ফটিকরা) আগেও অপরাধী ছিল, খুনি-মাফিয়া ছিল। কিন্তু, গ্রেফতার হয়নি। এখন দলের বিরুদ্ধে গেছে, তাই গ্রেফতার হয়েছে!”

thebengalpost.net
জেলা সভাপতি সুজয় হাজরা-র হাত ধরে তৃণমূলে যোগদান: