মণিরাজ ঘোষ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১ অক্টোবর: সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামীকাল-ই অবিভক্ত মেদিনীপুরের বুকে এক ‘নতুন ইতিহাস’ রচিত হতে চলেছে! একটানা প্রবল বর্ষণ আর অনভিজ্ঞ হাতে সংস্কারের প্রচেষ্টা– এই দুইয়ের ধাক্কায় বুধবার কাকভোরে উপড়ে পড়া সুপ্রাচীন বটগাছ-টিকে পুনরায় স্থাপন বা প্রতিস্থাপন (Re-placemenent) করা হবে আগামীকাল ‘গান্ধী জয়ন্তী’ (২ অক্টোবর)-র পুণ্য লগ্নে। জেলা প্রশাসন, ব্লক প্রশাসন এবং সর্বোপরি এলাকার বিভিন্ন সমাজকর্মী এবং বনদপ্তরের যৌথ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় আগামীকাল সেই ঐতিহাসিক কাজটি হতে চলেছে জঙ্গলমহল শালবনীর কর্ণগড় মন্দির প্রাঙ্গণে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে, আড়াবাড়ি ও ভাদুতলা বনাঞ্চলের (রেঞ্জ) পক্ষ থেকে, ওই একই স্থানে (এখনও অনেক শিকড় লেগে আছে) বটগাছটিকে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ নেপাল সিংহ। একই কথা জানিয়েছেন এই কাজের প্রধান দায়িত্বে থাকা আড়াবাড়ি বনাঞ্চলের রেঞ্জ অফিসার মলয় কুমার ঘোষ-ও। গত দু’দিন জেলা প্রশাসন ও বন দপ্তরের পক্ষ থেকে গাছটির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কর্ণগড়বাসী এবং মন্দির কমিটির সদস্যরা। উল্লেখ্য যে, রাজ্য রাজধানী কলকাতার বুকে এই ধরনের বৃক্ষ প্রতিস্থাপনের কাজ হলেও, অবিভক্ত মেদিনীপুরের বুকে এই প্রথম এই ধরনের ‘ঐতিহাসিক’ কাজ হতে চলেছে। উৎসাহিত, উদ্বেলিত, আবেগাপ্লুত অবিভক্ত মেদিনীপুরের সকল প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশ প্রেমী, সমাজকর্মী থেকে শুরু করে আপামর শালবনী ও মেদিনীপুর বাসী!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী তথা দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের নেত্রী রাণী শিরোমণি’র স্মৃতিধন্য ঐতিহাসিক কর্ণগড় মন্দিরের সামনে থাকা শতাব্দী প্রাচীন বট গাছটি বুধবার ভোর ৫ টা-সাড়ে ৫ টা নাগাদ উপড়ে পড়ে। সাতসকালে এই ‘অঘটন’ প্রত্যক্ষ করার পর, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে কর্ণগড়বাসীর! নিমেষের মধ্যে সেই ছবি সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর, শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েন দেবী মহামায়া তথা কর্ণগড় মন্দিরের আপামর ভক্তকুল! শুধু কর্ণগড়বাসী বা শালবনী বাসী নয়, এই মন্দির আর ওই সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ-টিকে কেন্দ্র করে অনেক ভালোবাসা-আবেগ-আত্মীয়তা মিশে ছিল সমগ্র অবিভক্ত মেদিনীপুর বাসীর। এমনিতেই বৃক্ষ মানুষের সহজাত বন্ধু! তাছাড়াও, প্রচন্ড গ্রীষ্ম কিংবা সামান্য বৃষ্টি’র সময় এই মন্দিরে আসা দর্শনার্থীদের এক পরম আশ্রয়স্থল ছিল এই বটবৃক্ষের ছায়াতল। তাই, দুঃখ পেয়েছিলেন সকলেই। দাবি উঠেছিল বৃক্ষ প্রতিস্থাপনের। মন্দির কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার ঘোষ বুধবার বিকেলেই জানিয়েছিলেন, “আমরা এই বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছি। প্রশাসন ও বন দপ্তরের সঙ্গে কথা বলছি।” হাজার হাজার মানুষের আবেগ আর উৎসাহে সাড়া দিয়ে, বৃহস্পতিবার সাত সকালেই পরিস্থিতি সরজমিনে খতিয়ে দেখতে, বনদপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের বন ও বনভূমি বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ নেপাল সিংহ এবং জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেডকোয়ার্টার) অম্লান কুসুম ঘোষ। ছিলেন, ভাদুতলা রেঞ্জের রেঞ্জ অফিসার পাপন মহান্ত এবং আড়াবাড়ি রেঞ্জের রেঞ্জ অফিসার মলয় কুমার ঘোষ সহ বনদপ্তরের অন্যান্য আধিকারিকরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শুক্রবার (২ অক্টোবর) সকাল থেকে বৃক্ষ প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করা হবে।
পশ্চিম মেদিনীপুর তথা অবিভক্ত মেদিনীপুরে এই ধরনের কাজ যেহেতু এই প্রথমবার করা হবে, তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন জেলা পরিষদের বন ও বনভূমি কর্মাধ্যক্ষ নেপাল সিংহ। কলকাতার বুকে এই ধরনের কাজ করে বিখ্যাত হওয়া, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার অর্জন বসু রায়ের সঙ্গেও ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল বলে জানা গেছে জেলা প্রশাসন সূত্রে। অন্যদিকে, মেদিনীপুর বনবিভাগের প্রাক্তন ডিএফও (DFO) তথা বর্তমানে, রাজ্য বন দপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক ড. রবীন্দ্রনাথ সাহা তাঁর সুচিন্তিত পরামর্শ দান করে সমৃদ্ধ করেছেন বলে জানিয়েছেন আড়াবাড়ির রেঞ্জ অফিসার মলয় কুমার ঘোষ। প্রথম থেকেই এই বিষয়ে উৎসাহী পরিবেশ প্রেমী রাকেশ সিংহ দেব থেকে শুরু করে কর্ণগড়ের জগন্নাথ পাত্র, নাগার্জুন সাউ কিংবা মেদিনীপুরের সমাজকর্মী নিসর্গ নির্যাস মাহাত-রা বনদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগে যারপরনাই খুশি! এই কাজের দায়িত্বে থাকা আড়াবাড়ি রেঞ্জের রেঞ্জ অফিসার মলয় কুমার ঘোষ জানিয়েছেন, “প্রথমে ডালপালা ছাঁটা হবে। তারপর ওখানেই বৃক্ষ প্রতিস্থাপন করা হবে। এরপর বৃক্ষের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা হবে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে। বাকিটা দেবী মহামায়ার ইচ্ছে!”
***পড়ুন: প্রবল বর্ষণে পড়ে গেল শালবনীর কর্ণগড় মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে থাকা সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ…