দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ড. শুভেন্দু ঘোষ: সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় বিশ্বের উপকুলীয় শহরগুলির ভবিষ্যত স্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে! আবহাওয়া পরিবর্তনের এই বর্তমান চালচিত্র ও কলকাতা শহরের ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বিচার করে, আবহাওয়াবিদরা এই শহরেরও ভবিষ্যৎ প্লাবনের আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (IPCC) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কলকাতা এবং এর আশেপাশের এলাকাগুলি ক্রমশ উষ্ণতর হচ্ছে, যার প্রধান কারন হিসেবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিষ্কাশন বৃদ্ধির বিষয়কে দায়ী করা হয়েছে। যেহেতু, কলকাতা শহরটির অধিকাংশ স্থানেরই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা মাত্র ৪ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে, তাই সাধারণ জোয়ারের সময় কলকাতা শহরের কাছাকাছি অবস্থান করে গঙ্গা নদীর জল। আবার, বর্ষাকালে ষাঁড়াষাঁড়ির বানের সময়, অনেক ক্ষেত্রে হুগলি নদীর জল পাড় ছাপিয়ে পড়ে ও বিশেষত গার্ডেনরীচ, খিদিরপুর ও টালিগঞ্জসহ আদিগঙ্গা বরাবর নিচু স্থানগুলিতে প্রবেশ করে। আবহাবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের হাত ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি অবস্থান করা পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে জলতল বৃদ্ধির কারণে নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যতে যে প্লাবন পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে, তাতে কলকাতার সম্ভাবনাই সর্বাগ্রে। কলকাতা শহরে অল্প জায়গার মধ্যে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম গ্রীনারি এখানে ভবিষ্যৎ প্লাবনের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই শহরের অপ্রতুল সবুজের আবরণের সাথে সাথে খোলা জায়গার পরিমান যথেষ্ট কম থাকা ও অতিরিক্ত পাকাকরণের কারণে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ জনিত প্রভাবে স্থানীয় তাপমাত্রা প্রায় রেকর্ড ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য এই সমস্যার সমাধানে বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত কোলকাতা শহরে সবুজ ও জলাভূমি রক্ষার্তে দীর্ঘদিন ধরে তৎপর।

thebengalpost.net
শহর কলকাতা প্লাবিত হতে পারে :

সাম্প্রতিককালে, শহরে বৃষ্টিপাতের চালচিত্রে এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। অল্প স্থান জুড়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত সংঘটিত হচ্ছে এবং প্রতিবছরই এই বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েই চলেছে, যা শহরকে প্লাবিত করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে, বঙ্গোপসাগরের কোলে সুন্দরবনে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা শতাব্দীর শেষে প্রায় ০.৬ মিটার বাড়তে পারে, যা উচ্চ জোয়ারের সময় শহরে বন্যার তীব্রতা এবং সময়কাল বৃদ্ধি করতে পারে। বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে বিগত কয়েক দশকে কলকাতা শহরে উষ্ণতা প্রায় ২.৬°সেঃ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা আরও আশঙ্কা করছেন যে আগামী ২০৮০ সালের মধ্যে এই শহরের গড় উষ্ণতা প্রায় ৪.৬°সেঃ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং যার প্রভাবে এই অঞ্চলে ঋতু বৈচিত্রে বিঘ্ন ঘটার সমুহ সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, একইসঙ্গে বছরে কমপক্ষে ১৫০ দিন ধরে গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর উপরে ঘোরাফেরা করবে বলে তাঁরা মনে করছেন। সুন্দরবনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বিশ্বব্যাপী গড়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবন থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহর কলকাতাতেও গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যথেষ্টই বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের জলের উর্ধ্বসীমা বাড়লে আরও তীব্র এবং দীর্ঘমেয়াদী বন্যার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে এবং স্ট্রম সার্জ( Storm surge) এর সময় এই ঢেউয়ের উচ্চতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

thebengalpost.net
গীন হাউসের প্রভাবে প্রতিবছর বাড়ছে বৃষ্টি :

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অরুণাভ মজুমদার বলছেন, “উদ্ভুত পরিস্থিতি এই পুরাতন পরিকাঠামোযুক্ত ও নদীর পলিমাটির উপর গড়ে উঠা শহরটির ক্ষেত্রে সামাল দেওয়া অত্যন্ত দূরহ। স্বল্প সময়ের মধ্যে অতি বৃষ্টিপাতের ঘটনা উত্তরোত্তর যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে নিকাশিব্যাবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে”। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজি(IITM) এর বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, কৃষ্ণান রাঘবান বলছেন, “অদূর ভবিষ্যতে বর্ষার সময়, প্রকার ও তীব্রতার সহজাত পরিবর্তনশীলতার কারণে, মৌসুমী বৃষ্টিপাতে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে”। তাঁর মতে, শতাব্দীর শেষ নাগাদ কলকাতায় “একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে। শহরে দিনে রেকর্ড ১১৮ মিমি হতে পারে।” বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, “এইভাবে চললে আগামীদিনে অত্যন্ত মারাত্মক বা সুপার সাইক্লোন প্রকোপ সুন্দরবনে বাড়তে পারে, যা কলকাতা এবং খুলনার মতো শহরগুলিকে যথেষ্টই প্রভাবিত করবে যদি না গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন মাত্রা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।” তবে, বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ কোনো একটি শহরের বা নির্দিষ্ট কোনো দেশের প্রচেষ্টায় সম্ভবপর নয়, এক্ষেত্রে প্রতিটি দেশেরই একযোগে কাজ করা উচিত। কলকাতা শহরেও এই সম্পর্কিত বেশ কিছু দূষণ নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ জরুরি, যার কিছুটা সুফল স্থানীয়ভাবে পাওয়া যেতেও পারে। যেমন, সবুজের আবরণ বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, শহরে মধ্যে জনসংখ্যার চাপ কমানোর লক্ষে পরিকল্পনামাফিক জনসংখ্যার বহির্মুখী প্রসারণ। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিসহ অন্যান্য জলাভূমিগুলির সংরক্ষণ ও সংস্কার, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথে প্রাকৃতিক বাধাস্বরূপ সুন্দরবনকে রক্ষা করা ও ম্যানগ্রোভের প্রসার ঘটানো। বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠেকাতে গ্রীনহাউস গ্যাসগুলির অতিরিক্ত নির্গমন বন্ধ এবং স্থানীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, যেমন ইলেক্ট্রিক এবং সোলার চালিত যানবাহন চলাচল বাড়ানো ও রেন ওয়াটার হার্ভেষ্টিং এ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এছাড়াও, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির দহনকে নিয়ন্ত্রণ ও জনসাধারণের মধ্যে সার্বিক সচেতনতার লক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে। (লেখক ড. শুভেন্দু ঘোষ পরিবেশ গবেষণা সংস্থা TIEER এর গবেষক।)