thebengalpost.net
উত্তর ভারতের ঝঞ্জা ভোগাচ্ছে বাংলাকেও :

দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, শুভেন্দু ঘোষ, ২৮ ডিসেম্বর: ভারতীয় উপমহাদেশে শীতকালীন আবহাওয়ার পরিবর্তনে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা (Western Disturbances) হলো অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। ভারতে শীতের পারদ ওঠা নামাতে সাম্প্রতিক অতিতের প্রতি বছরের মতোই চলতি বছরেও এই ঝঞ্ঝার হাত ধরে এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার এই অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় তাপমাত্রার বৃদ্ধি ও হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়েছে। মধ্য অক্ষাংশের উপক্রান্তীয় অঞ্চলে পশ্চিমা জেটের (WJ) সংযোগে সৃষ্ট ঘুর্ণিঝড় এই আবহাওয়ার পরিবর্তনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। আমাদের দেশে শীতেকালে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার ভ্রুকুটি সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। শীতকালে ভূমধ্যসাগর ও স্পেনের নিকটবর্তী আটলান্টিক মহাসাগরের থেকে আগত ঘূর্ণবাতের প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে হালকা বৃষ্টিপাত এবং পার্বত্য অঞ্চল সমূহে তুষারপাত হওয়ার ঘটনাকে  পশ্চিমী ঝঞ্ঝা বা পশ্চিমী ঝামেলা বলা হয়। এই পশ্চিম দিক থেকে আগত ঘূর্ণবাতের প্রভাবে শীতকালীন রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া বিঘ্নিত হয় বলেই এর নাম পশ্চিমী ঝঞ্ঝা বা পশ্চিমী ঝামেলা। আবার শীতকালেই এর প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় বলে একে উইন্টার ডিস্টারব্যান্সও বলা হয়ে থাকে।

thebengalpost.net
পশ্চিমি ঝঞ্জা’র ফলে বৃষ্টির ভ্রুকুটি (প্রতীকী ছবি) :

যদিও আই এম ডি (IMD) এর বিজ্ঞানীদের মতে, ভারতে এই বছর শীতকাল ‘জলবায়ু পরিবর্তনের’ (climate change) দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁদের মতে বিশ্ব উষ্ণায়ন “লা নিনা’ নামক ঘটনার প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলবে যা এই বছর উত্তর ভারত জুড়ে শীতের তাপমাত্রা বেশ খনিকটা কমিয়ে দেবে বলে আসা করা যায়। ‘লা নিনার’ দিক পরিবর্তন ও বাণিজ্য বায়ুর প্রভাব ভারতের উত্তর- পশ্চিম অংশে শীতকালকে দীর্ঘ ও শীতল করে। ‘লা নিনার’ প্রভাবে এশিয়ার উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে সাইবেরিয়া থেকে বাধাহীন শীতল বায়ু ভারতে শীতকালকে শীতল ও দীর্ঘস্থায়ী করে। এছাড়াও সাইবেরিয়া থেকে বিষুবরেখার দিকে বাতাসের দক্ষিণমুখি গতি ভারতে শৈত্যপ্রবাহের অবস্থা সৃষ্টি করে। আইআইটি বোম্বের অধ্যাপকদের সমীক্ষায় উল্লেখ কিরা হয়েছে যে ভারতীয় উপমহাদেশে সাইবেরিয়া এবং দক্ষিণ চীন থেকে ঠান্ডা বাতাস মসৃনভাবে প্রবাহিত হলে শীতকাল শীতল ও স্থায়ী হয়। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমী ঝামেলার উপর্যুপরি প্রভাবের কথা চিন্তা করে আইএমডি কিছু কিছু ক্ষেত্র পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত, জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের বেশিরভাগ অংশ এবং লাদাখ, রাজস্থান, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কিছু অংশে মাঝে মাঝে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রার বিরাজ করার কথাও বলেছেন।

thebengalpost.net
উত্তর পূর্ব ভারতকে ভোগাচ্ছে এই পশ্চিমি ঝঞ্জা (প্রতীকী ছবি) :

সারা বছর ধরে উপক্রান্তীয় জেটের প্রভাবে এই পশ্চিমী ঝঞ্ঝার উপস্থিতি থাকলেও বিশেষত শীতকালে (ডিসেম্বর – মার্চ) এর প্রত্যক্ষ প্রভাব অধিক লক্ষ করা যায়। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত ইউক্রেন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উচ্চচাপ সৃষ্টি হওয়ায় উত্তর মেরু, বিশেষত সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আগত শীতল বায়ু প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় ওই অঞ্চলে অধিক আর্দ্রতাযুক্ত অপেক্ষাকৃত উষ্ণ বায়ুর উদ্ভব ঘটে এবং একইসঙ্গে ঐ অঞ্চলের বায়ুমন্ডলের উচ্চ স্তরে (৩০০০ফুট) ঘুর্নবাত সৃষ্টির অনুকূল অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ ভূমধ্যসাগরের উপর দুর্বল নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চলের বাইরে সৃষ্ট এই ধরনের ডিপ্রেশনকে বলা হয় এক্সট্রা ট্রপিক্যাল ডিপ্রেশন বা অতিক্রান্তীয় নিম্নচাপ। পরবর্তীতে ট্রপওস্ফিয়ারের মাঝ বরাবর বা কখনো কখনো নিম্ন সীমা জুড়ে ভূপৃষ্ঠের উপর প্রবাহিত পশ্চিমা জেট(STWJ) বায়ুর হাত ধরে ডিপ্রেশনটি ক্রমশ পূর্বদিকে প্রায় ৪৩ কিলোমিটার প্রতিঘন্টা হিসাবে অগ্রসর হতে থাকে। আগমনপথে কাস্পিয়ান সাগর ও পারস্য উপসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাস্প সংগ্রহ করে ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান অতিক্রম করে উত্তর পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে এবং অবশেষে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অংশে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত ঘটায় এবং পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাত সংগঠিত করে। পশ্চিমী ঝঞ্ঝার চরিত্র ও শক্তি অনুযায়ী বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও বন্টন অনেকাংশে নির্ধারিত হয়। প্রতি বৎসরই শক্তিশালী পশ্চিমী ঝঞ্ঝার কারণে হিন্দুকুশ ও কারাকোরাম পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে।

thebengalpost.net
পশ্চিমি ঝঞ্ঝা উৎপত্তিস্থল :

কখনও কখনও, যখন পশ্চিমী ঝামেলা অনেক বেশি জলীয় বাস্প সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে তখন ইহা বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে, যার ফলে উত্তর মহারাষ্ট্র, গুজরাট এবং দক্ষিণে সমগ্র মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। মূলতঃ মেঘলা আকাশ, রাত্রিকালীন তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং ভোরের বেলার ঘন কুয়াশা শীতকালীন ভারতে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার উপস্থিতি জানান দেয়। শীতকালের ঘন মেঘ এবং শৈত্যপ্রবাহের অবস্থার স্থায়িত্ব অনেকাংশে নিয়ন্ত্রন করে এই পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। দীর্ঘসময় ধরে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার একটানা অনুপস্থিতি শীতের প্রাবল্য বৃদ্ধি করে ও শৈত্যপ্রবাহের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। কোনও একটি শীত মরসুমে সাধারণভাবে ৪-৫ টি এই ধরনের পশ্চিমী ঝামেলার প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও বর্তমানে এরও বেশি দেখা যাচ্ছে। শীতের শেষের দিকে ক্রমশ পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রকোপ কমতে থাকে এবং এই সময় উত্তর পশ্চিম ভারতে অস্থায়ীভাবে কিছুটা প্রাকমৌসুমি বায়ুপ্রবাহের উপস্তিতি অনুভূত হয়। শীত পরবর্তী সময়ে এপ্রিল-মে মাসে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিমে অগ্রসর হয় এবং একই সময়ে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মৌসুমি বলয় ও পশ্চিমী ঝঞ্জার সংযোগ ও আন্তক্রিয়ার ফলে ঘন কালো মেঘ ও প্রচুর বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়।

thebengalpost.net
মেঘলা আকাশ আর কুয়াশা :

একথা অনস্বীকার্য যে রবি শস্য চাষে বিশেষত গম, যব, সরিষা, ছোলা, মসুর ইত্যাদি চাষে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টিপাত খুবই কাজে লাগে। শীতের মরসুমে পূর্বে প্রায় বিহারের পাটনা পর্যন্ত এই বৃষ্টিপাত চাষীদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, অনেক সময় আবার দেখা যায় এর প্রভাবে অতিবৃষ্টি জনিত বন্যা ও পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধস বিপর্যয় সৃষ্টি করে। অপরদিকে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবেই উত্তরের শীতল হওয়ার যেমন গতি রুদ্ধ হয়, ঠিক এভাবেই প্রভাবে শীতকালীন বৃষ্টিপাত পশ্চিম বঙ্গ সহ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যে আলুসহ বিভিন্ন শাকসবজি চাষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করে। যেহেতু, পশ্চিমী ঝঞ্ঝা উচ্চ-তীব্রতার কোনো ঘুর্ণিঝড় নয়, তাই সাধারণভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর থেকে সংঘটিত দুর্যোগের সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে অনেকক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে। ২০১০ সালে লেহ প্রদেশে পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় মেঘভাঙা বৃষ্টিতে বহু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ২২৫ জন লোক মারা যায়। অন্যদিকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, কাশ্মীরের বেশ কয়েকটি জেলায় ঝঞ্ঝার কারনে বিপর্যয়কর বন্যা প্রায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রান কেড়ে নেয়। উত্তরাখণ্ডে ২০১৩ সালের বন্যার বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে পশ্চিমী ঝামেলার প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞেরা দ্বিধাবিভক্ত। এই রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলে তিন দিনের অবিরাম বৃষ্টির ফলে বন্যা ও ভূমিধ্বসে প্রায় ৫০০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে উত্তর ভারত ও তিব্বত মালভূমি অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটেছে। বিগত ৫০ বছরে প্রায় ২.৫°সেঃ তাপমাত্রা বেড়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে। তাই, একথা অনস্বীকার্য যে পশ্চিমী ঝামেলার চরিত্রগত পরিবর্তন ও উপমহাদেশে এর উপর্যুপরি প্রকোপ বৃদ্ধি শীতকালে আঞ্চলিক তাপমাত্রার পতনে প্রধান অন্তরায়। (লেখক ভূগোল বিষয়ের শিক্ষক এবং বিশিষ্ট পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘টিয়ার’ (TIEER) এর গবেষক ডঃ শুভেন্দু ঘোষ।)