দ্য বেঙ্গল পোস্ট বিশেষ প্রতিবেদন, ড. শুভেন্দু ঘোষ, ১৪ জানুয়ারি: সারা বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্যজনিত দূষণ আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জল, স্থল ও বায়ুমন্ডল সর্বত্র সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণার আকারে এই মনুষ্যসৃষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্যর গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের সাথে তাল মিলিয়ে দিনের দিন বর্জ্য প্লাস্টিকজনিত দূষণ মানব শরীর সহ সমগ্র জীবজগতকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পরিবেশবিজ্ঞানী থম্পসনের মতে, “১৯৭০ সালের গোড়ার দিক থেকে আমরা পরিবেশের মধ্যে ক্ষুদ্র বর্জ্য প্লাস্টিকের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলাম। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমরা এই দূষণের ভৌগলিক বিস্তার, সঞ্চয় এবং পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়েছি এবং কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করেছি।” বিগত কয়েক দশকের এই ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক বর্জ্য মৃত্তিকা, জল ও বায়ু দূষণজনিত সমস্যাকে এতটাই ঘোরতর করে তুলেছে যে, মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি (Microplastics) এখন বায়ুমণ্ডলে চলমান জলচক্র সহ অন্যান্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক চক্রের উপাদান হিসেবে আবর্তিত হচ্ছে। একটি নতুন গবেষণা অনুসারে, এই প্লাস্টিকের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রায় অদৃশ্য কনাগুলি অক্সিজেন বা জলের মতো আমাদের গ্রহের চারপাশে বায়ুতে মিশে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন শহরগুলো দূষণের দিক থেকে, পৃথিবীর সামনের সারিতেই রয়েছে। IQ-AIR(2020) এর সমীক্ষানুযায়ী বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত ৩০ টি শহরের মধ্যে ২২ টি ভারতেই অবস্থিত। ২০২০ সালে কলকাতায় একটি সমীক্ষায় PM 2.5 এর যে হিসেব উঠে এসেছে তা হল, পরিবহন থেকে নির্গত দূষণ -৬৫৪০ টন/বছর; গৃহস্থালির কাজকর্ম থেকে নির্গত দূষণ- ৭৭০০ টন/বছর; শিল্পকারখানা থেকে নির্গত দূষণ- ৪৮৩৫০ টন/বছর; রাস্তা ও নির্মাণকার্য থেকে নির্গত দূষণ- ৭৯৫০ টন/বছর; খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানোর ফলে নির্গত দূষণ -৬২৫০ টন/বছর; জেনারেটর থেকে নির্গত দূষণ- ৪৬৫০ টন/বছর এবং ইঁটভাটা থেকে নির্গত দূষণ- ৬৮৫০ টন/বছর।

thebengalpost.net
প্লাস্টিকের বিষ :

পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর শহরের মতো কয়েকটি ব্যস্ততম স্থানে ২০২০ সালের লকডাউনের আগে পরিবেশ সংস্থা TIEER এর করা সমীক্ষাতে কয়েকটি উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছিল। সেই সময় বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমান ছিল ৪৮০-৫২০ পিপিএম, যা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ২০০ পিপিএম বেশি। এছাড়াও, সাল্ফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড এর পরিমানও বেশি ছিলো। এখন দেখে নেওয়া যাক, এই সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্লাস্টিকের কনাগুলি কিভাবে বাতাসে মিশে যায় এবং আমাদের শ্বাস নেওয়ার সময় শ্বাসনালীর ভেতর দিয়ে শরীরে ঢুকে পড়ে? আবার এই প্লাস্টিক কণাযুক্ত শ্বাস নেওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কি কি করনীয় অথবা বাতাসে ভাসমান এই বর্জ্যকে নিয়ন্ত্রণই বা করা যাবে কোন পথে? ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA) এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে সর্বাধিক ৫ মিলিমিটার জুড়ে অবস্থান করা বর্জ্য প্লাস্টিকের কণাগুলি মাইক্রো প্লাস্টিক (Micro Plastic) দূষণের জন্য দায়ী। মহাসাগর, হ্রদ, তুষার এবং বৃষ্টিপাত ও বায়ু ছাড়াও সমস্ত প্রকার জলাশয়ে প্লাস্টিক কনার অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। এই বর্জ্য প্লাস্টিকের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণাগুলি বাস্পীভবনের মাধ্যমে জল থেকে বাতাসে স্থানান্তরিত হয় এবং স্বাভাবিক জলচক্রে আবর্তিত হয়ে পূনরায় বৃষ্টিপাতের উপাদান হিসেবে পৃথিবীপৃষ্ঠে ফিরে আসে। চিকিৎসা সংক্রান্ত বর্জ্য জলভাগে প্লাস্টিকদূষণের অন্যতম নির্ধারক। এছাড়াও, শহরাঞ্চলে লন্ড্রিগুলিতে সিন্থেটিক জামা কাপড় ধোয়ার সময় যথেষ্ট পরিমানে মাইক্রোপ্লাস্টিক জলে দ্রবীভূত হয়। প্রাত্যহিক ক্রমবর্ধমান পলিয়েস্টার এবং পলিপ্রোপিলিন জাতীয় জিনিসপত্রের ব্যবহারও জল ও বায়ুমন্ডলে এই অস্থানিক ক্ষতিকর উপাদানটির বৃদ্ধির জন্য দায়ী। শহরাঞ্চলে রাস্তায় গাড়ির টায়ারের ঘর্ষণে ছোট ছোট টায়ারের টুকরো উড়ে বায়ুমন্ডলে সরাসরি মিস্রন ছাড়াও রোজকার প্লাস্টিক বা সিন্থেটিক জিনিসের ব্যবহার যেমন জুতার তলায় এবং গৃহস্থালির বিভিন্ন পাত্র থেকে এই ধরনের প্লাস্টিক দূষণ সংঘটিত হয়। সামুদ্রিক জাহাজ ও পরিবাহী পেট্রো রাসায়নিক পণ্যসামগ্রী থেকে সমুদ্র দূষণ ঘটে। সামুদ্রিক ফেনা এবং রাস্তার পৃষ্ঠ থেকে উদ্ভুত প্লাস্টিকের কণা বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বিভিন্ন মহাদেশব্যাপী সর্বত্র প্রবাহিত হয়।

thebengalpost.net
সর্বাধিক প্লাস্টিক বর্জ্য যুক্ত অঞ্চল :

আমেরিকার দক্ষিণের ১১ টি পৃথক স্থানে ২০১৭ ও ২০১৯ সালের মধ্যে সংগৃহীত ৩১৩ প্লাস্টিক বর্জ্য কনার উপর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বায়ুতে ভাসমান ৮৪ % প্লাস্টিক কনার উৎসই হল ভাষমান রাস্তার ধুলো। এছাড়াও, অন্যান্য উৎসগুলির মধ্যে ১১% সামুদ্রিক ফেনা ও ০.৪% মানুষের ব্যবহার্য প্লাস্টিক রয়েছে। অন্যদিকে, বায়ুতে মিশ্রিত এই সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম প্লাস্টিক বর্জ্যগুলি অতি সহজেই শ্বাস নেওয়ার সময় সরাসরি মানুষের ফুসফুসে চলে আসে অস্থানিক পদার্থ হিসেবে। ফলস্বরূপ শ্বাসনালীতে ক্ষত সৃষ্টি, ফোলাভাব, ফুসফুসের টিস্যুতে ফোলাভাব প্রভৃতি নানাবিধ ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে হালকা বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট অনুভবও হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে, মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি মানুষের ফুসফুসে অ্যালভিওলি তৈরি করে ক্ষতি করতে পারে। আবার এই দূষকের প্রভাবে এমফিসেমা এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষুদ্রতম প্লাস্টিক কনাগুলি রক্তের প্রবাহে মিশ্রিত হয়ে ধমনীকে শক্ত করে দেয়, যা অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস ও হার্টের ব্লকেজ জনিত সমস্যার কারণ হতে পারে। যেহেতু বায়ুমন্ডলে প্লাস্টিক দূষণের হার শিল্পাঞ্চল ও শহরাঞ্চলিতে সর্বাধিক, তাই এই সমস্ত অঞ্চলে নির্গত প্লাস্টিক কথাগুলি কার্বনসহ বিভিন্ন বিপজ্জনক পদার্থে আবৃত হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে। জীবাশ্ম জ্বালানির দহন ও ধুমপানের কারণে, শহরের বায়ুতে এই ধরনের পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (PAHs) জাতীয় বিপজ্জনক পদার্থের সংমিশ্রণ ঘটে। ফলস্বরূপ চোখ জ্বালা, শ্বাস কষ্ট, বমি বমি ভাব, কিডনি এবং লিভারের ক্ষতি, ছানি জন্ডিস বন্ধ্যাত্ব এবং ত্বক, ফুসফুস, মূত্রাশয়, লিভার বা পাকস্থলীর ক্যান্সার এর মতো গুরুতর সমস্যাও দেখা দিতে পারে। বায়ুমন্ডলে প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণের থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রগুলির বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং সুনিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে টেকসই বাস্তুতন্ত্রের লক্ষে আমাদের সর্বক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতেই হবে। ২০০৯ সালের সমীক্ষায় প্লাস্টিকের সর্বোত্তম বিকল্পগুলির উল্লেখ করা হয়েছিলো। কাষ্ঠভিত্তিক পলিমার এর ব্যবহার বৃদ্ধি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের অধিকতর ব্যবহার এবং সস্তা ও পাতলা পলিথিন ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বর্জনের মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণে সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে। (লেখক ড. শুভেন্দু ঘোষ বিশিষ্ট শিকক, পরিবেশবিদ এবং TIEER এর গবেষক)

thebengalpost.net
দূষণের মাত্রা: