দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৯ এপ্রিল:”এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার?” এই প্রশ্নটাই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে জেলা শহর মেদিনীপুরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে! শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। কোনো অভাব রাখেননি বাবা-মা। সেই মেয়েরই মা-কে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপল না! প্রেমিকের সঙ্গে পরামর্শ করে মা-কে কোল্ড ড্রিঙ্কস বা ঠাণ্ডা পানীয়ে বিষ জাতীয় কিছু মিশিয়ে (খাইয়ে) হত্যা করল দশম শ্রেণীর ছাত্রী। শুধু তাই নয়, মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর বছর ১৮ এর প্রেমিকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে (বা, মেসেঞ্জারে) তা ‘শেয়ার’ করে আনন্দ প্রকাশও করল! মায়ের অপরাধ নাবালিকা মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি! ঘটনাটি, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঐতিহ্যমন্ডিত জেলা শহর মেদিনীপুরের। মেদিনীপুর শহরের কোতোয়ালী থানা দু’সপ্তাহের মাথায় এই খুনের কিনারা করে নাবালিকা কন্যা, তার প্রেমিক এবং প্রেমিকের বাবা-মা’কে গ্রেপ্তার করল।
পুলিশ ও মৃতার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ ১ লা বৈশাখের (১৫ এপ্রিল) দিন সন্ধ্যার দিকে মেদিনীপুর শহরের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী পরিবারের গৃহবধূ অনিতা দত্ত -কে তাঁর বছর ১৫’র বড় মেয়ে (দশম শ্রেণীর ছাত্রী) কোল্ড ড্রিঙ্কসের সঙ্গে বিষ জাতীয় কিছু মিশিয়ে খাইয়ে দেয়। সেই কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ার পরই বছর ৪৫ এর অনিতা দেবী অচৈতন্য হয়ে পড়েন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মারাও যান। স্থানীয় এক চিকিৎসক-কে ডেকে আনা হলে, তিনি মৃত্যু নিশ্চিত করলেও, দ্রুত মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর, পরিবার পরিজনেরা অনিতা দত্তকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে, চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় অনিতা দেবীর স্বামী সহ পরিবার-পরিজনেরা বুঝে উঠতেই পারছিলেন না কিভাবে ঘটনাটি ঘটলো! কারণ, রীতিমতো সুস্থ অনিতা দেবী নববর্ষের দিন সন্ধ্যা অবধি নিজেদের দোকানেই ব্যস্ত ছিলেন। তারপর বাড়ি ফিরে সামান্য কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতেই মৃত্যু! গত ১৫ এপ্রিল থেকে এভাবেই কেটে যায় ২৭ এপ্রিল অবধি। হঠাৎ রহস্যের উন্মোচন হয় ২৭ এপ্রিল রাতে!
শহরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী’র পরীক্ষা চলছে। তা সত্ত্বেও মোবাইলে কারুর সঙ্গে চ্যাট করতে ব্যস্ত থাকায়, পরিবারের লোকেরা বকাবকি করেন এবং মোবাইল-টি জোর করে হাত থেকে কাড়িয়ে নেন। এরপর, মেয়ে যার সাথে চ্যাট করছিল, তা পর পর দেখতে দেখতেই ‘চক্ষু চড়কগাছ’ হয় পরিবারের! তাতে ১৫ এপ্রিলের চ্যাটে লেখা, ওইদিন কি কি হয়েছিল, কিভাবে সে সবকিছু করেছিল- এইসব। জানা যায়, মেদিনীপুর শহরের মহাতাবপুরের বাসিন্দা প্রেমিক জিৎ আঢ্যের (আইটিআই পাঠরত) প্ররোচনায় এবং তারই এনে দেওয়া একাধিক ঘুমের ওষুধ (N-10 জাতীয় কোনো ওষুধ বলে প্রাথমিক ধারণা) বা বিষাক্ত কিছু দ্রব্য গুঁড়ো করে কোল্ড ড্রিঙ্কসের সঙ্গে মিশিয়ে মা-কে খাইয়ে দেয় নাবালিকা। এমনকি, দিদিকে নাকি তা গুঁড়ো করতে দেখে মা-কে সাবধান করেছিল বছর দশেকের ছোট মেয়ে। যদিও, তা গুরুত্ব দেননি অনিতা দেবী! এরপরই, বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) অনিতা দত্তের পরিবারের তরফে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয় নাবালিকা মেয়ে, তার প্রেমিক এবং প্রেমিকের বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগের ভিত্তিতে, মেদিনীপুর কোতয়ালী পুলিশ চারজনকেই গ্রেপ্তার করে। শুক্রবার নাবালিকা মেয়েকে জুভেনাইল কোর্টে তোলা হয়। তাকে আপাতত শহরের সরকারি হোমে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। বাকি তিনজনকে মেদিনীপুর আদালতে তোলা হলে, বিচারক বছর ১৮’র প্রেমিক জিৎ-কে তিন দিনের পুলিশ হেফাজত এবং তার বাবা-মা’ (রঞ্জিত আঢ্য ও লেখা আঢ্য)-কে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন। এমনটাই জানিয়েছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী মহম্মদ নাজিম হাবিব। জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার জানিয়েছেন, “খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। নিজের মা-কেই খুন করেছে মেয়ে। তদন্তে সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” গোটা ঘটনায় শহরবাসী একপ্রকার স্তব্ধ!