দ্য বেঙ্গল পোস্ট প্রতিবেদন, পশ্চিম মেদিনীপুর, ৩০ ডিসেম্বর:’অনাস্থা’ প্রকাশ করে বা ‘ক্ষোভ’ উগরে দিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়েছিলেন আগেই। এবার, তৃণমূলের ১১ জন কাউন্সিলর দলেরই মনোনীত চেয়ারম্যান সৌমেন খান-কে প্রকাশ্য ‘অবস্থান মঞ্চ’ থেকে ‘চরম হুঁশিয়ারি’ দিলেন! দলেরই মহিলা কাউন্সিলর লিপি বিষই (১১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর) সহ অন্যান্য মহিলা কাউন্সিলরদের শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহে অভিযুক্ত শ্রমিক নেতা তপন মুখার্জি ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের ‘প্রশয়’ দেওয়ার মারাত্মক অভিযোগ তুললেন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে! বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত ওই শ্রমিকনেতার বিরুদ্ধে FIR না করে, উল্টে ‘পৌরসভার দেওয়ালে’ কাউন্সিলরের (লিপি বিষইয়ের বিরুদ্ধে) বিরুদ্ধেই পড়া পোস্টার জ্বলজ্বল করে ‘শোভা বর্ধন’ করার পেছনেও চেয়ারম্যানের পরোক্ষ মদতের বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে ‘বিদ্রোহী’ ১১ জন কাউন্সিলরের তরফে বিশ্বনাথ পাণ্ডব (১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর) প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “ভুলে যাবেন না, ‘দল’ আপনাকে চেয়ারম্যান করেছে!”
তিনি (বিশ্বনাথ পাণ্ডব) এও বলেন, “চেয়ারম্যানকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, গত ৫ ডিসেম্বর দলের মহিলা কাউন্সিলরদের যারা নিগ্রহ করছিল, ধাক্কা দিয়েছিল, শ্লীলতাহানি করেছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ (FIR) দায়ের করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বোর্ড মিটিংয়ে। আপনি তা করলেন না! উল্টে দলেরই একজন মহিলা কাউন্সিলরের (লিপি বিষইয়ের) বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে পৌরসভার দেওয়ালে পোস্টার পড়লো! আপনার প্রশ্রয় ছাড়া কিভাবে এটা হয়? গোটা শহর জুড়ে দেওয়া হলো পোস্টার। শহরবাসী আমাদের প্রশ্ন করছেন। আমরা উত্তর দিতে পারছিনা! আমরা লজ্জিত, আমরা তৃণমূল কংগ্রেস দলটা প্রথম দিন থেকে করে আসছি। দলের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের নেতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের নেত্রী!” বিশ্বনাথের এই বক্তব্যের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘মিছিল’ করে জেলাশাসকের কাছে লিপি বিষইয়ের বিরুদ্ধে স্মারকলিপি জমা দিতে গেলেন তপন মুখার্জি’র নেতৃত্বে ৬০-৭০ জন সাফাইকর্মী। মিছিল থেকে একদিকে যেমন ‘লাল সেলাম’ স্লোগান দিলেন তপন মুখার্জি, ঠিক তেমনই ২০০ জন ‘ঠিকা শ্রমিক’ নিযুক্ত করায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘চেয়ারম্যান’ সৌমেন খান এর নামে ‘জয়ধ্বনি’ দিতেও শোনা গেল! আর, এতেই যেন বিশ্বনাথ পাণ্ডব সহ ১১ জন ‘বিদ্রোহী’ কাউন্সিলরের করা চেয়ারম্যানের সঙ্গে শ্রমিক নেতার (তপন মুখার্জির) ‘গোপন আঁতাত’ এর অভিযোগ আরও ‘নগ্নরূপে’ প্রকাশিত হয়ে গেল! যদিও, বৃহস্পতিবার তৃণমূল কংগ্রেসের ১১ জন কাউন্সিলরের অবস্থান চলাকালীন চেয়ারম্যান সৌমেন খান খোদ বিশ্বনাথ পাণ্ডব-কে পাশে নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ‘সাফাই’ দিয়েছেন, “পৌরসভার জঞ্জাল পরিষ্কারের পরিষেবায় যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য আইনানুগ পদক্ষেপ করা হয়নি। তবে, লিখিত অভিযোগের কপি রেডি করাই আছে। বোর্ড মিটিংয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদেরকে তো কাউন্সিলরদের সম্মানের দিকটিও দেখতে হবে।” তিনি এও বলেন, ১১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের (লিপি বিষইয়ের) বিরুদ্ধে শহরজুড়ে যে সমস্ত পোস্টার পড়েছে, তা খুলে নেওয়া হবে! যদিও, ‘সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন’ এর নেতা তপন মুখার্জি বৃহস্পতিবার দুপুরেও জানিয়েছেন, সাফাইকর্মীদের ‘জাত’ তুলে অপমান করার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ৫ ডিসেম্বর পৌরসভায় সাফাইকর্মীদের ‘বেতন কেটে’ নেওয়ার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছিল, সেখানেই সাফাইকর্মীদের ‘জাত’ তুলে আক্রমণ করার অভিযোগ উঠেছিল লিপি বিষইয়ের বিরুদ্ধে। যদিও, লিপি জানিয়েছিলেন, “মিথ্যে অভিযোগ।” তাঁর বিরুদ্ধে তফশিলি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি’র বিরুদ্ধেও তাঁর যুক্তি ছিল, “আমি নিজেই তো তফশিলি সম্প্রদায়ের মানুষ।”
সবমিলিয়ে, মেদিনীপুর পৌরসভায় এই মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলছে বিদ্রোহের ‘আগুন’! দলের ২০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১১ জন প্রকাশ্যে তোপ দেগেছেন। অবস্থানে বসেছেন। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ‘গোপন’ চিঠি দেওয়ার পর, প্রকাশ্যে ‘সরব’ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই, খড়্গপুর পৌরসভার পর মেদিনীপুর পৌরসভাতেও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ‘ক্ষোভ’ তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলরদের ‘বিদ্রোহ’ এর ঢেউ যেভাবে আছড়ে পড়লো, তা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ শহরবাসীর মুখে মুখে এখন তৃণমূলের সেই চিরাচরিত ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের’ ই মুখরোচক গল্প! তৃণমূলের ১১ জন ‘বিদ্রোহী’ কাউন্সিলরকে সমর্থন করেও তাই ২৪ নং ওয়ার্ডের বর্ষীয়ান সিপিআইএম কাউন্সিলর গোপাল ভট্টাচার্য বললেন, “ওঁদের (১১ জন কাউন্সিলরের) বিক্ষোভ দেখানোর সঙ্গত কারণ আছে। ওকে (তপন মুখার্জিকে) পৌরসভায় ঢুকতে দেওয়া উচিত হয়নি। ওর বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। তবে, তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল নিয়ে নতুন করে কি আর বলবো! সে তো আছেই।” জেলা তৃণমূলের সভাপতি সুজয় হাজরা জানিয়েছেন, “মহিলা কাউন্সিলরদের নিগ্রহ করার ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সাফাইকর্মীদের পাশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা আমাদের দল সর্বদা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু, যে বা যাঁরা এই কাণ্ড (মহিলা কাউন্সিলরদের নিগ্রহ) ঘটিয়েছেন তাঁদের প্রতি ধিক্কার জানাই। বাকি বিষয়ে দলীয়ভাবে কিছু বলার নেই। কাউন্সিলররা বা চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।”